২০১৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ফরাসি ঔপন্যাসিক প্যাত্রিক মোদিয়ানো। এর আগে ২০১২ তে অস্ট্রিয়ান স্টেট প্রাইজ ফর ইউরোপিয়ান লিটারেচার, ২০১০ এ আজীবন সম্মাননা হিসেবে Institut de France থেকে Prix mondial Cino Del Duca, ১৯৭৮ সালে Rue des boutiques obscures এর জন্য Prix Goncourt এবং ১৯৭২ সালে Les Boulevards de ceinture এর জন্য Grand Prix du roman de l’Académie française পুরস্কার পেয়েছিলেন।

প্যাত্রিক মোদিয়ানোর লেখালেখি ফ্রান্সে বেশ সমাদৃত এবং ৩০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ার। এবং ইংরেজিতে অনূদিত তার প্রথম দিকের অনেকগুলি কাজই আর বাজারে নেই।
শুরুর দিকের ও ব্যক্তিগত জীবন
জ্যাঁ প্যাত্রিক মোদিয়ানো ১৯৪৫ সালের ৩০ জুলাই ফ্রান্সের প্যারিসের পশ্চিম শহরতলীতে Boulogne-Billancourt নামে জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন। এটি প্যারিসের ৮.২ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
তার বাবা আলবার্ট মোদিয়ানো (১৯১২-১৯৭৭, জন্ম. প্যারিস) ইহুদি ছিলেন, তিনি এসেছিলেন স্যালোনিয়ার একটি বিখ্যাত সেপহারডিক পরিবার থেকে। প্যাট্রিক মোদিয়ানোর মা লুইসা কলপিন ছিলেন বেলজিয়ান অভিনেত্রী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ প্যারিসে তার বাবা-মায়ের দেখা হয় এবং তাদের সম্পর্ক শুরু হয়। সে সময়ে আলবার্ট মোদিয়ানো কালো বাজারে ব্যবসা করতেন।
প্যাত্রিক মোদিয়ানো প্রথমে তার নানা-নানির কাছে বড় হতে থাকেন। তারা তাকে বেলজিয়ান ভাষা শেখান। তার বাবার অনুপস্থিতিতে এবং তার মায়ের মাঝে মাঝে ভ্রমণের এই সময়ে তার ভাই রুদির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। পরে রুদি তার দশ বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে মারা যায়। প্যাত্রিক মোদিয়ানো তার ১৯৬৭ থেকে ১৯৮২ সালের কাজগুলি এই ভাইকে উৎসর্গ করেছেন।
তার স্মৃতিকথামূলক বিখ্যাত বই উন পেডিগ্রিতে তিনি এই দুঃখজনক সময়ের কথা বলেছেন: আমি কোনো আত্মজীবনী লিখতে পারি নি, তাই আমি এটিকে বলেছি ‘বংশতালিকা’। এই বইতে আমি যা করেছি তা কমই আছে, অন্যরা যা করেছে তাই বেশি আছে, মূলত আমার বাবা-মা আমাকে যা করেছে।

মোদিয়ানো জোয়ে-এন-জোসাসে École du Montcel প্রাইমারি স্কুলে, হাওতে-স্যাভোইয়ে Saint-Joseph de Thônes এ এবং পরে প্যারিসে Lycée Henri-IV হাই স্কুলে পড়াশনা করেন। তিনি যখন হেনরি-ফোর এ ছিলেন তখন লেখক Raymond Queneau এর কাছে জ্যামিতি শেখেন। Raymond Queneau মোদিয়ানোর মায়ের বন্ধুও ছিলেন।
তিনি Annecy থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন, এরপরে আর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন নি।
মোদিয়ানো ১৯৭০ সালে দোমিনিক জেহরফাসকে (Dominique Zehrfuss) বিয়ে করেন। ২০০৩ সালে এক সাক্ষাৎকারে দোমিনিক বলেন, আমার কাছে আমাদের বিয়ের দিনের একটি সর্বনাশা স্যুভেনির আছে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। একটি সত্যিকারের দুঃস্বপ্ন। আমাদের বরযাত্রীরা ছিল প্যাত্রিকের শিক্ষক কিউনিয়েও এবং আমার বাবার একজন বন্ধু ম্যালরউক্স। তারা ছবি তোলা নিয়ে তর্ক করা শুরু করে এবং আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা একটি টেনিস ম্যাচ দেখছি। বলা হয়েছিল কিছু ছবি থাকলে ভালো হবে, কিন্তু শুধু একজনের ক্যামেরা ছিল এবং সে ফিল্ম আনতে ভুলে গিয়েছিল। আমাদের একটি মাত্র ফটোই আছে, সেটি পিছন দিক থেকে এবং ছাতার নিচে।
এই দম্পতির দুইজন মেয়ে জিনা (জন্ম ১৯৭৪) এবং ম্যারি (জন্ম ১৯৭৮)।
লেখালেখির ক্যারিয়ার
লেখক কিউনিয়েও এর সাথে তার দেখা হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিউনিয়েও মোদিয়ানোকে সাহিত্য জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
তিনি মোদিয়ানোকে Éditions Gallimard এর দেওয়া একটি ককটেল পার্টিতে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ দেন। এই Éditions Gallimard পরে মোদিয়ানোর প্রকাশক হয়েছিল। একজন ইহুদি বিশ্বাসঘাতককে নিয়ে লেখা মোদিয়ানোর প্রথম উপন্যাস La Place de l’étoile প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে।
প্রকাশিত হওয়ার আগে তিনি পাণ্ডুলিপি কিউনিয়েওকে দিয়ে পড়িয়ে নেন। উপন্যাসটি পড়ে মোদিয়ানোর বাবা নাখোশ হন, তাই মোদিয়ানো বাজার থেকে এই বইয়ের সব কপি কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
আলজেরিয়ান যুদ্ধের সময় প্যারিসে থাকার সময়ে মোদিয়ানো তার বাবার কাছে কিছু আর্থিক সহযোগিতা চাইলে তার বাবা পুলিশ ডেকেছিলেন।
২০১০ সালে জার্মান ভাষায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে এ উপন্যাসের জন্য মোদিয়ানো সাউথ-ইস্ট রেডিও বেস্ট অব লিস্টের পুরস্কার জিতে নেন। তারা বইটিকে হলোকাস্টের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে উল্লেখ করে।
মোদিয়ানোর বেশিরভাগ কাজই জার্মান ভাষায় অনূদিত হলেও এই উপন্যাসটিতে অ্যান্টি-সেমেটিক উপাদান থাকায় বইটি অনূদিত হতে ৪২ বছর সময় লাগে। এই বইটি এখনো ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় নি।

১৯৭৩ সালে Louis Malle পরিচালিত Lacombe, Lucien ছবির চিত্রনাট্যের সহ-লেখক ছিলেন। সিনেমার কাহিনী ছিল ফ্রেঞ্চ গেস্টাপোর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি ছেলেকে নিয়ে, সে ফ্রান্সে অবস্থানরত জার্মান বাহিনির কাছে ফরাসি সীমানায় ঢুকে পড়ার কথা অস্বীকার করে। প্রধান চরিত্রের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় নায্যতার অভাবে সিনেমাটি নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।

মোদিয়ানোর উপন্যাসে সবসময় পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি থাকে, ব্যক্তির অতীতের চিহ্ন অনুসরণ করে তার অস্তিত্বের প্রমাণ কীভাবে পাওয়া যায় সেটি নিয়ে ধাঁধা থাকে। মোদিয়ানো তার সব উপন্যাসেই এই থিম নিয়ে আসেন। এই ধরনের বিষয়ে একের পর এক বই মোদিয়ানোর লেখালেখিকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
মোদিয়ানো বলেছেন, প্রতিটি উপন্যাসের শেষে আমার মনে ছাপ থাকে যে আমি পুরোটাই স্পষ্ট করেছি। কিন্তু আমি জানি আমি ছোট ছোট ডিটেইল স্পষ্ট করার জন্য বার বার ফিরে আসব। ছোট ছোট যে জিনিসগুলি আমার অংশ। শেষপর্যন্ত আমরা যে স্থানে এবং যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেছি তার দ্বারা সংজ্ঞায়িত।
তিনি ক্রমাগত প্যারিস, এর রাস্তাঘাট, লোকজন, তাদের অভ্যাস প্রভৃতি নিয়ে লিখতে থাকেন।
মোদিয়ানোর সব লেখাই শুরু হয় ম্যানিয়া (mania) নামক জায়গা থেকে। তার Dora Bruder উপন্যাসে স্মৃতির থিমটি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে কাজ করেছে। পরে এটি ইংরেজিতে দি সার্চ ওয়ারেন্ট নামে প্রকাশিত হয়। এই বইটি বায়োগ্রাফি, অটোবায়োগ্রাফি এবং ডিটেকটিভ উপন্যাস এই তিন ধরনের মিশ্রণ। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নামে উপন্যাসটির নাম।
পূর্ব ইউরোপে অভিবাসী ১৫ বছরের একটি ইহুদি মেয়ে নিরাপত্তা কনভেন্ট থেকে পালিয়ে যায় এবং শেষপর্যন্ত তাকে আসউইজ (Auschwitz) কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্বাসিত করা হয়।

মোদিয়ানো বলেছেন ফরাসি সংবাদপত্র Paris Soir এ ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকায় দোরার নাম দেখে তার গল্প সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছিলেন। মোদিয়ানো পত্রিকায় দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে তার তদন্ত শুরু করেছিলেন। এটি ছিল তার স্মৃতির অনুসন্ধান। তিনি পেপার কাটিং, বিভিন্নজনের সাক্ষ্য, পুরাতন টেলিফোন ডিরেক্টরি, শহরের আশেপাশের মানুষজনের জীবনযাত্রা এ সব মিলিয়ে উপন্যাসটি লিখেছিলেন।
তিনি বলেন, আমি কখনোই জানব না সে কীভাবে দিন কাটাত, সে কোথায় লুকিয়েছিল, তার পলায়নের পর কাদের সাথে সে শীতের সময় কাটিয়েছিল অথবা দ্বিতীয়বার যখন পালিয়েছিল কাদের সাথে বসন্তের শুরুর সময় কাটিয়েছিল। এটিই তার গোপনীয়তা।
নাইট মুভস সহ মোদিয়ানোর উগ্র উপন্যাসগুলি অনুতাপে পরিপূর্ণ থ্রিলার।

মোদিয়ানোর ২৬ তম বই L’Horizon (২০১১) এ বর্ণনাকারী জা বসম্যানস একজন ভঙ্গুর ব্যক্তি এবং তার মায়ের ভূত তাকে অনুসরণ করছে। ১৯৬০ এর দশকে সে হেয়ালিপূর্ণ চরিত্র মার্গারেট লা কজের প্রেমে পড়ে। প্যারিসের রাস্তায় এই নিঃসঙ্গ দুজন কয়েক সপ্তাহ ঘুরে বেড়ায়। হঠাৎ একদিন মার্গারেট কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই ট্রেনে উঠে চলে যায়। কিন্তু সে জা এর স্মৃতি থেকে হারায় না। চল্লিশ বছর পরে জা তার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ভালোবাসার দিকে পিছন ফিরে তাকায়।
এই উপন্যাসে শুধু মোদিয়ানোর নিজস্ব স্টাইলই নেই, বার্লিনে রহস্যময় ভ্রমণের পরে এটি মোদিয়ানোর ব্যক্তিগত অন্বেষণে নতুন একটি ধাপ যুক্ত করেছে।

তিনি বলেন, শহরটির বয়স আমার সমান। এর দীর্ঘ জ্যামিতিক এভিনিউগুলি এখনো ইতিহাসের চিহ্ন বহন করে। কিন্তু আপনি যদি ডানে তাকান তাহলে এখনো কংক্রিটের নিচে পতিত জমি দেখতে পাবেন। সেখানে আমার প্রজন্মের শিকড় রয়ে গেছে।
এই শিকড় থেকেই অনেক বছর ধরে ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম সুন্দর গাছটি বেড়ে উঠেছে।
মোদিয়ানোর কিছু কাজ ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। যেমন, Les boulevards de ceinture (১৯৭২; রিং রোডস: এ নভেল, ১৯৭৪), Villa Triste (১৯৭৫; ভিলা ত্রিস্তে, ১৯৭৭), Quartier perdu (১৯৮৪; এ ট্রেস অব ম্যালিস, ১৯৮৮) এবং Voyage de noces (১৯৯০; হানিমুন, ১৯৯২)।
তার সাম্প্রতিকতম কাজ Pour que tu ne te perdes pas dans le quartier (২০১৪)।
মোদিয়ানো শিশুদের জন্যও বই লিখেছেন।
স্বীকৃতি
তাকে বলা হয় আমাদের সময়ের মার্সেল প্রুস্ত।
তার নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ঘোষণায় বলা হয়, তার পুরস্কার প্রাপ্তি স্মৃতির যে আর্টের মাধ্যমে তিনি সবচেয়ে অস্পৃশ্য মানব লক্ষ্যগুলি তুলে ধরেছেন এবং জীবনের সামগ্রিকতা উন্মোচন করেছেন তার জন্য।
Like সাহিত্য ডটকম on Facebook
Jardin du Luxembourg পাশ দিয়ে প্যারিসের রাস্তায় হাঁটার সময় তার মেয়ের মোবাইল কলের মাধ্যমে তিনি নোবেল প্রাপ্তির খবর জানতে পারেন।তার কাজের সাথে পরিচিতদের কাছেও তার নোবেল পাওয়ার ঘটনা অপ্রত্যাশিত ছিল। তার অল্প সংখ্যক কাজই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তার অনেকগুলি এখন বাজারে আর নেই।

তার ইংরেজিতে ১৯৮০ সালে অনূদিত মিসিং পারসন ( Prix Goncourt পুরস্কারপ্রাপ্ত Rue des boutiques obscures; ১৯৭৮ ) উপন্যাসটি নোবেল ঘোষণার ঠিক আগ পর্যন্ত আমেরিকায় ২৪২৫ কপি বিক্রি হয়েছে। সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সেক্রেটারি পিটার ইংলান্ড বলেছেন, ফ্রান্সের বাইরে অনেক মানুষের কাছেই হয়ত মোদিয়ানো এবং তার কাজ অপরিচিত। ঘোষণার পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মোদিয়ানো ফ্রান্সে বেশ পরিচিত, কিন্তু অন্য কোথাও না।