আমরা প্রায়ই আইডিওলজি (Ideology) শব্দটা ব্যবহার করি মতাদর্শ, ভাবাদর্শ বা মতবাদ বোঝাতে। এই শব্দটা আমাদের মাঝে প্রচলিত হয়েছে মূলত মার্ক্সীয় চিন্তাধারার প্রভাবে। বিশেষ করে কার্ল মার্ক্স আর ফ্রিডরিখ অ্যাঙ্গেলসের বিখ্যাত বই ‘The German Ideology’ (দ্য জার্মান আইডিওলজি) এর ব্যাপক ভূমিকা আছে এখানে। কিন্তু, মার্ক্সের চিন্তায়, মার্ক্সীয় চিন্তায়, আর পোস্ট-মার্ক্সিস্ট চিন্তায় যেভাবে আইডিওলজি বিশ্লেষিত হয়েছে, তাতে আইডিওলজিকে শুধু মতবাদ বা মতাদর্শ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।

বিষয়টা আরও গভীর, আরো গূঢ়—এটার সম্পর্ক মানুষের চেতনা, উপলব্ধি আর বোধের সাথে। মানুষ তার চারপাশের জগতের সাথে যে সম্পর্ক তৈরি করে, আইডিওলজি সেই পর্যায়ে কাজ করে।


তাহ্‌সিন আহমেদ অমি


মার্ক্স আইডিওলজির ধারণা ব্যবহার করেছিলেন মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ করার জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে মার্ক্সীয় চিন্তকরা এই ধারণার বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। যারা এই কাজটা করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ফরাসি মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক লুই আলথুসার—মার্ক্সের প্রস্তাবকে বিশ্লেষণ করে, কিছু জায়গায় খণ্ডন করে, আর কিছু জায়গায় অতিক্রম করে গিয়ে আইডিওলজির একটা সাধারণ তত্ত্ব হাজির করেছেন।

২.
আইডিওলজি শব্দটা এসেছে গ্রিক “আইডিয়া” (Idea) আর “লগিয়া” (Logia) থেকে—যেখানে আইডিয়া মানে চিন্তা, আর লগিয়া মানে গবেষণা বা অধ্যয়ন। অর্থাৎ, আইডিওলজির মূল অর্থ দাঁড়ায় চিন্তার অধ্যয়ন বা চিন্তার বিজ্ঞান।

ফরাসি বিপ্লবের সময় এন্তনি দেস্তুত দে ত্রেসি নামে এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে কারাবন্দি করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের বাস্তবতা দেখে তিনি ভাবছিলেন, সমাজে কোনো চিন্তার প্রসার কীভাবে ঘটে? তখন তিনি কারাগারে বসেই “আইডিওলজি” শব্দটা ব্যবহার করে কিছু লেখালেখি করেন। পরে যখন ক্যু এর মাধ্যমে ফরাসি বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারী অন্যতম ব্যক্তি, রবেস্পিয়ারের শিরোশ্ছেদ করা হয়, তখন দে ত্রেসি মুক্তি পান এবং তার চিন্তাগুলিকে ‘The Elements of Ideology’ (দি এলিমেন্টস অফ আইডিওলজি) নামক বই আকারে প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে, নেপোলিয়ন এই শব্দটা ব্যবহার করেন তার লিবারেল প্রতিপক্ষদের ব্যঙ্গ করতে, যেখানে তিনি তাদের আইডিওলগ্‌স (Ideologues) বলে অপমান করতেন। সেই থেকে শব্দটার ব্যবহার বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বদলাতে থাকে।

৩.
আমরা আজ যে অর্থে আইডিওলজি বুঝি, সেটার সাথে মূল সম্পর্ক কার্ল মার্ক্সের। তিনি তার রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিচারে সমাজকে Base (ভিত্তি) আর Superstructure (অবকাঠামো) এই দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন।

বেস হল একটা সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা, উৎপাদন ব্যবস্থা, উৎপাদন সম্পর্ক ইত্যাদি। এক কথায় বেস হল সমাজের বস্তুগত বাস্তবতা। আর এই বেসের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে থাকে সুপারস্ট্রাকচার, যেখানে আছে সমাজের ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, রাজনীতি ইত্যাদি।

Karl Marx (৫ মে ১৮১৮ – ১৪ মার্চ ১৮৮৩)

মার্ক্স বলছেন, আইডিওলজি মূলত এই সুপারস্ট্রাকচারের অংশ, এই সুপারস্ট্রাকচার গঠনকারী যাবতীয় উপাদান, আমরা যেমন বলে থাকি—রাজনৈতিক মতাদর্শ, নৈতিক মতাদর্শ, ধর্মীয় মতাদর্শ ইত্যাদি। যেহেতু সুপারস্ট্রাকচারের উৎপত্তি বেস থেকে, ফলে আইডিওলজিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা সবসময় ওই সমাজের বস্তুগত অবস্থার ছবিই দেখতে পাব।

৪.
আইডিওলজি হল সমাজের বস্তুগত অবস্থার একটা বহিঃপ্রকাশ। এসকল আইডিওলজির মূল কাজ সমাজের ক্ষমতাশালী শ্রেণির চিন্তাধারাকেই একমাত্র বলে প্রতিষ্ঠিত করা। শাসক শ্রেণির আইডিওলজি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শাসিত শ্রেণি শাসক শ্রেণির বিশ্বাস, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সেটাকেই স্বাভাবিক আর বিকল্পহীন বলে ধরে নেয়। ‘দ্য জার্মান আইডিওলজি’ বইতে মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলস লিখেছেন—

“প্রত্যেক যুগে শাসক শ্রেণির চিন্তাগুলিই সমাজে কর্তৃত্ব বিস্তার করে: অর্থাৎ, যেই শ্রেণিটা সমাজের শাসনকারী বস্তুগত শক্তি, সেটাই একইসাথে এর শাসনকারী বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি।”

[“The ideas of the ruling class are in every epoch the ruling ideas: i.e., the class which is the ruling material force of society is at the same time its ruling intellectual force.”]

Antoine Louis Claude Destutt, comte de Tracy (২০ জুলাই ১৭৫৪ – ৯ মার্চ ১৮৩৬)

তারা বলতে চাচ্ছেন যে, সমাজের বস্তুগত অবস্থার ওপর, মানে উৎপাদন প্রক্রিয়া, অর্থনীতি প্রভৃতির ওপর যে শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ থাকে, সমাজে প্রচলিত চিন্তা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ প্রভৃতির ওপরও সেই শ্রেণিরই নিয়ন্ত্রণ থাকে। যারা মানুষের বস্তুগত অবস্থার ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করে, তারা মানুষের চিন্তাজগতকেও করায়ত্ত করে নেয়।

শাসক শ্রেণি সবসময়ই এই আইডিওলজি শাসিতদের ওপর চাপিয়ে দেয়, কারণ তার মাধ্যমেই নিশ্চিত করা যায় যে এই পুরো উৎপাদন ব্যবস্থা বা সমাজব্যবস্থাও টিকে থাকবে, ফলে শ্রেণি হিসাবে তাদের টিকে থাকাও নিশ্চিত হবে।

শাসিত বা শোষিত শ্রেণি যদি শাসকদের তৈরি করা আইডিওলজিতে আটকে থাকে, তাহলে তারা নিজেকে শোষিত বলেই মেনে নেবে, ভাববে যে এটাই তাদের নিয়তি। ফলে তারা শাসকদের বা গোটা সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রতিবাদ করবে না। আর এসব কারণেই মার্ক্সের কাছে আইডিওলজি কোনো ভাল জিনিস না। এটা আসলে বাস্তবতা থেকে উৎপন্ন একটা বিভ্রম—একটা বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি। ‘দ্য জার্মান আইডিওলজি’ বইতেই মার্ক্স বলছেন—

সকল আইডিওলজিতেই মানুষ আর তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা হাজির হয় উল্টাভাবে, ক্যামেরা অব্‌স্কুরার মতো [ক্যামেরা অবস্কুরা ছিল মার্ক্সের যুগের এক ধরনের ক্যামেরা যেটায় উলটা ছবি উঠত], এই ঘটনাটা সেভাবেই তাদের ঐতিহাসিক জীবন-প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হয় যেভাবে রেটিনাতে বস্তুর ছবি উল্টিয়ে যায় তাদের শারীরিক জীবন-প্রক্রিয়ার জন্য।

[“In all ideology, men and their circumstances appear upside down as in a camera obscura, this phenomenon arises just as much from their historical life-process as the inversion of objects on the retina does from their physical life-process.”]

৫.
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক শ্রেণি কেন নিজেদের দুর্দশা বুঝতে পারে না বা কেন শ্রেণিসংগ্রাম নিয়ে সচেতন হয় না, সেটা বোঝাতেই মার্ক্স এই আইডিওলজির ব্যাপারটা এনেছিলেন।

বলা যায়, প্রলেতারিয়াতের চোখের সামনে একটা ‘আইডিওলজির পর্দা’ টাঙানো থাকে, যা তাদের আসল বাস্তবতা দেখতে দেয় না। এই বিষয়টাকে অনেকসময় বলা হয় False Consciousness বা বিভ্রান্ত চৈতন্য।

যেমন, পুঁজিবাদে ধর্মীয় আইডিওলজির কারণে কেউ ভাবতে পারে যে তার দুঃখ-কষ্ট আসলে তার কর্মের ফল, অথবা এই কষ্টের বিনিময়ে সে পরকালে পুরস্কার পাবে। আবার, নৈতিক আইডিওলজিতে আক্রান্ত হলে সে মনে করবে যে মালিকের সাথে করা চুক্তি পালন করাটাই তার নৈতিক দায়িত্ব। রাজনৈতিক আইডিওলজির কারণে সে ভাববে যে একজন বড় শিল্পপতি আর একজন সাধারণ শ্রমিক—দুজনই রাষ্ট্রের চোখে সমান নাগরিক।

এইভাবেই আইডিওলজি মানুষকে তার দুর্দশা মেনে নিতে শেখায়। তাদের বুঝতেই দেয় না যে এই শোষণ একটা কাঠামোগত বিষয়, আর এই কাঠামো ভেঙে পুনর্গঠন করাও সম্ভব। যেহেতু তারা এটা বুঝতে পারে না, তাই তারা সোচ্চার হয় না, প্রতিবাদ করে না।

মার্ক্স তার কাজের বিভিন্ন জায়গায় আইডিওলজির উদাহরণ দিয়েছেন, বিশেষ করে ‘দ্য জার্মান আইডিওলজি’ বইতে। কিন্তু কোথাও একদম গোছানো ভাবে আইডিওলজির একটা সাধারণ তত্ত্ব হাজির করেননি। আইডিওলজির একটা সাধারণ তত্ত্ব বলতে বোঝানো হচ্ছে সকল আইডিওলজির একটা মৌলিক তত্ত্ব, যা দিয়ে সকল আইডিওলজিকে ব্যাখ্যা করা যাবে। একে “আইডিওলজি ইন জেনারেল” এর তত্ত্ব বলা যায়। মার্ক্স এই আইডিওলজি ইন জেনারেল নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেননি। তিনি বরং দেখিয়েছেন, বিভিন্ন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আইডিওলজি কীভাবে কাজ করে, আর এর প্রভাব কী।

৬.
আইডিওলজির একটা সাধারণ তত্ত্ব হাজির করার চেষ্টা করেন বিংশ শতাব্দীর ফরাসি মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক লুই আলথুসার। তিনি ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তিনি কাঠামোবাদী (Structuralism) ধারার অন্তর্ভুক্ত।

কাঠামোবাদী ধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল নির্দিষ্ট ঘটনার বিশ্লেষণের চেয়ে সেই ঘটনাকে একটা কাঠামোগত প্রবণতা হিসাবে দেখার ওপর জোর দেওয়া। আলথুসারও একইভাবে আইডিওলজির নির্দিষ্ট উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করার চেয়ে একটা সাধারণ তত্ত্ব খুঁজতে চেয়েছেন যা দিয়ে সকল আইডিওলজিকে ব্যাখ্যা করা যায়। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক অবদান হল আইডিওলজি নিয়ে তার বিশ্লেষণ, যা তিনি তুলে ধরেছেন ‘Ideology and Ideological State Apparatus’ (আইডিওলজি অ্যান্ড আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস) প্রবন্ধে।

এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে ‘La Pensée’ নামক ফরাসী সাময়িকীতে। মূল প্রবন্ধটি ছিল ফরাসি ভাষায়, নাম ‘Idéologie et appareils idéologiques d’État (Notes pour une recherche)’. ১৯৭১ সালে প্রবন্ধটির ইংরেজি অনুবাদ ‘Lenin and Philosophy and Other Essays’ গ্রন্থে সংকলিত হয়।

আলথুসার দেখান যে প্রতিটা নির্দিষ্ট আইডিওলজির নিজস্ব একটা ইতিহাস থাকতে পারে—অর্থাৎ, কীভাবে সেটার উৎপত্তি হল, কীভাবে পরিবর্তন হল, এসব নিয়ে আলোচনা করা যায়। কিন্তু আইডিওলজি ইন জেনারেল এর কোনো ইতিহাস নেই। মার্ক্সও তার ‘দ্য জার্মান আইডিওলজি’ বইতে এই বিষয়টা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এটা বলার মাধ্যমে যে মেটাফিজিক্স বা এথিক্সের কোনো ইতিহাস নেই।

মানে, এগুলির বিবর্তন হয় না—বিবর্তন হয় শুধু বস্তুগত অবস্থার। বিষয়টা এমন যে, কেউ যদি ধর্মীয় আইডিওলজিতে আটকে থাকে, তাহলে তার কাছে মনে হবে তার বিশ্বাস চিরন্তন। সে কখনও ভাববেও না যে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল। কিন্তু কেউ যদি ধর্মের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করে, তার কাছেই ধর্ম একটা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসাবে ধরা দেবে—যেমনটা মার্ক্সের কাছে আইডিওলজি ধরা দিয়েছে।

কিন্তু আলথুসার যখন বলেন যে আইডিওলজি ইন জেনারেল এর কোনো ইতিহাস নেই, তিনি সেটা নেতিবাচকভাবে দেখেন না, মার্ক্সের মত। মার্ক্স যখন বলেন যে কোনো আইডিওলজির ইতিহাস নেই, তখন তিনি বোঝান যে এটা ইতিহাস থেকে বঞ্চিত। কিন্তু আলথুসার বলেন, এটা বরং পজিটিভ একটা ব্যাপার—আইডিওলজির ইতিহাস না থাকার মানে হল, এটা সমগ্র ইতিহাস জুড়ে বিস্তৃত, এটা Omni-historical. অথবা সহজভাবে বললে, আইডিওলজির বাইরে গিয়ে ইতিহাসচর্চাও সম্ভব না। যেহেতু ইতিহাসচর্চাও কোনো না কোনো আইডিওলজির ভেতর থেকেই হয়, তাই বলা যায় যে, আইডিওলজির বাইরে কিছুই নেই। আমরা সবসময়ই কোনো না কোনো আইডিওলজির মধ্যে আছি। এমন কোনো মুহূর্ত নেই যেখানে বলা যাবে—”এই মুহূর্তে আমি আইডিওলজিতে ঢুকলাম!” আমরা Always-Already বা সর্বদা-ইতোমধ্যেই এর ভেতরে আছি।

এখানে আলথুসার আইডিওলজিকে ফ্রয়েডের অচেতনের (Unconscious) সঙ্গে তুলনা করছেন, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা তুলনা। মার্ক্স যেভাবে আইডিওলজির ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা অনেকটা ফ্রয়েডের আবির্ভাবের আগে প্রচলিত স্বপ্ন ব্যাখ্যার মত ছিল। ফ্রয়েডের আগে মনে করা হত স্বপ্ন আসলে সারাদিনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি আর চিন্তাভাবনার যে অংশ আমাদের মস্তিষ্কে থেকে গিয়েছে, তার একটা যথেচ্ছ মিশ্রণ, এর বেশি কিছুই না।

মার্ক্সও আইডিওলজিকে দেখেছিলেন বস্তুগত জগতের একটা বিকৃত চিন্তাগত উপস্থাপন হিসাবে। কিন্তু ফ্রয়েড এসে দেখালেন স্বপ্ন আসলে আমাদের অচেতন থেকে আসে, আমাদের অচেতনে অবদমিত কামনা-বাসনা, স্মৃতি ইত্যাদিই স্বপ্নের কারণ। আর ফ্রয়েডের মতে এই অচেতন এক অর্থে চিরন্তন—মানে, মানুষ হিসাবে আমরা কখনোই এমন সময় কল্পনা করতে পারি না যখন অচেতন বলে কিছুই ছিল না, কেননা আমাদের মানুষ হওয়াটাই অচেতনের কারণে। আলথুসারও সেভাবেই আইডিওলজিকে দেখছেন।

আলথুসার দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রে মার্ক্সকে অতিক্রম করে যাচ্ছেন, সেটা হল—মার্ক্স যেভাবে আইডিওলজিকে বিশ্লেষণ করেছিলেন, তাতে আমরা ব্যক্তির আইডিওলজির আড়ালে তার বস্তুগত অবস্থাকেই পেতাম বা সুপারস্ট্রাকচার বিশ্লেষণ করলে তার বেসকে পেতাম। কিন্তু আলথুসার দেখাচ্ছেন যে বিষয়টা ঠিক এমন না। মার্ক্সের সবচেয়ে মৌলিক থিসিস ছিল—একটা সমাজব্যবস্থায় মানুষ যেসব ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যেমন উৎপাদক, ভোক্তা, শোষক, শোষিত ইত্যাদি—এসব ভূমিকা উদ্ভূত হয় উৎপাদন সম্পর্ক আর উৎপাদন সম্পর্ক হতে উৎপন্ন সম্পর্কগুলি থেকে।

অর্থাৎ একটা পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি কোথা থেকে আসবে, কার অধিকারে থাকবে, কীভাবে বিন্যস্ত হবে ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়গুলি যে ক্ষমতার সম্পর্কের মাধ্যমে ঠিক হয় সেগুলিই উৎপাদন সম্পর্ক। আর এইসব সম্পর্ক থেকে শ্রমিক, মালিক, ভোক্তা ইত্যাদি পরিচয়গুলির মাঝে নানান রকমের সম্পর্ক উৎপন্ন হয়। মানে সমাজে অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলিই মানুষের এসকল পরিচয় ঠিক করে দেয়। আর এই পরিচয়গুলি আসলে আইডিওলজিক্যাল।

আইডিওলজির মাধ্যমেই তো আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হই। তাহলে আইডিওলজিগুলি মানুষ আদতে যেই বস্তুগত অবস্থায় আছে সেটা প্রকাশ করে না, বরং প্রকাশ করে সেই বস্তুগত অবস্থার সাথে ওই মানুষের সম্পর্ক ঠিক কেমন সেটাকে।

আমি “যেই ভাবে” আমার বস্তুগত পরিস্থিতির সাথে সম্পর্ক রচনা করি, সেইটাই আমার পরিচয় নির্ধারণ করে। আর সেই কাজটা করে দেয় আইডিওলজি। এভাবে ভাবা যায়, আমি যদি আমার বন্ধুর সাথে খারাপ আচরণ করি, সেটা আসলে আমার সাথে আমার বন্ধুর সম্পর্ক কেমন সেটার দিকে ইঙ্গিত করে, আমার খারাপ আচরণ থেকে আমার বন্ধুর আসল চরিত্র সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্তেই আসা যায় না। বরং আমি যে বলে বেড়াই “আমার বন্ধু মানুষ হিসাবে খারাপ বলেই আমি ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছি”, সেটা নিজেই আমার সাথে বন্ধুর সম্পর্কের ফলাফল।

মানে আমার বন্ধুর আসল চরিত্র সম্পর্কে আমি যে দাবি করি সেটাও আমার সাথে আমার বন্ধুর সম্পর্কের ওপরই নির্ভরশীল, বন্ধুর আসল চরিত্রের ওপর না। এই বিষয়টাকে আলথুসার বলবেন আইডিওলজি অফ আইডিওলজি। মানে, আইডিওলজি বিষয়ে আমাদের ধারণাও নির্দিষ্ট আইডিওলজির প্রভাবে আইডিওলজিক্যাল বিকৃতির শিকার হতে পারে।

৭.
এরপর আলথুসার প্রস্তাব করছেন যে আইডিওলজির একটা বস্তুগত অস্তিত্ব আছে, আইডিওলজি স্রেফ চিন্তাগত বা ভাবগত বিষয় না, আমরা সচরাচর যেমনটা ভেবে থাকি। এখানে আইডিওলজি শব্দটার বাংলা অনুবাদের দিকে একটু খেয়াল করা প্রয়োজন। সাধারণত আমরা মতবাদ অর্থে আইডিওলজির বাংলা মতাদর্শ বা ভাবাদর্শ করে থাকি। যেমন মার্ক্সিস্ট আইডিওলজি বলতে মার্ক্সের মতবাদকে বোঝানো হয় সাধারণ অর্থে। কিন্তু মার্ক্সই যেই অর্থে আইডিওলজি শব্দটা ব্যবহার করছেন তাতে আরো অধিক কিছুর ব্যঞ্জনা আছে, আইডিওলজি শুধু মতবাদের বিষয় না বরং মানুষ বাস্তবতাকে যেভাবে দেখে আর যাপন করে, সেটারও বিষয়।

Louis Pierre Althusser (১৬ অক্টোবর ১৯১৮ – ২২ অক্টোবর ১৯৯০)

দুইটার মধ্যে সম্পর্ক আছে ঠিকই, কিন্তু সাধারণত সেই সম্পর্কের কথা মাথায় রাখা হয় না বাংলা অনুবাদ প্রয়োগ করার সময়। আর আলথুসার নিঃসন্দেহে আরো গুরুতর কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করছেন, তাই এই আলোচনায় আইডিওলজির বাংলা না করাই সমীচিন।

বস্তুগত বলতে আলথুসার বিশেষ কিছু বোঝাচ্ছেন, অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে যেই ধরনের বস্তুবাদ গড়ে উঠেছিল এইটা ঠিক সেই অর্থে বস্তু না। বস্তুর অস্তিত্বের বিভিন্ন অবস্থা বা Modality আছে—আইডিওলজি সেই বিশেষ একটা মোডালিটিতে বস্তুগত। উদাহরণ হিসাবে ধরতে পারেন, অণু-পরমাণু যেই অর্থে বস্তু, একটা তরঙ্গ বা শক্তি সেই অর্থে বস্তু না। অথচ এইগুলি সবই ভৌতবিজ্ঞানের ক্যাটাগরি বা বর্গ, ফলে বস্তুগত হলেও এইগুলি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বস্তু।

আইডিওলজির বস্তুগত হওয়া বলতে আলথুসার বোঝাচ্ছেন যে আইডিওলজি সক্রিয় হয় বিভিন্ন অ্যাপারেটাসের (Apparatus) দ্বারা সংঘটিত বিভিন্ন প্র্যাকটিসের (Practice) মধ্য দিয়ে। অ্যাপারেটাস অর্থ যন্ত্র, এখানে সেই অর্থে যন্ত্র যেই অর্থে আমরা “রাষ্ট্রযন্ত্র” বলে থাকি।

আলথুসার এসব যন্ত্রের নাম দিচ্ছেন Ideological State Apparatus (আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস), বা সংক্ষেপে ISA. যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন সকালে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া—যার মধ্য দিয়ে আমাকে দেশের আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা হয়, বা উপাসনালয়ে জমায়েতের মাধ্যমে ধর্মচর্চা করা—যার মধ্য দিয়ে আমাকে প্রচলিত নৈতিকতার মানদণ্ড আত্মস্থ করানো হয়, বা আরো সূক্ষ্ম ক্ষেত্রে, আদালতে বিচারক এলে উঠে দাঁড়ানো, বিচারকার্য শেষে বা আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিচারকের গ্যাভেল (ছোট কাঠের হাতুড়ির মত জিনিসটা) দিয়ে টেবিলের ওপর আঘাত করা—এসবের দ্বারা আইনের প্রতি আমাদের আনুগত্য নিশ্চিত করা হয়।

এগুলি সবগুলিই আইডিওলজিক্যাল। এসব প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়েই আইডিওলজি অস্তিত্বশীল হয়ে ওঠে, জীবন্ত হয়ে ওঠে। এইসব প্র্যাকটিসের বাইরে আইডিওলজির ভিন্ন কোনো অস্তিত্ব নেই। আর এইসব প্র্যাকটিস একেবারেই বস্তুগত, কারণ এইসব ঘটছে বস্তুজগতেই। বস্তুজগতের বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বাইরে এইসব প্র্যাকটিসের মধ্যে অতিন্দ্রীয় কিছু নাই। এই অর্থেই আলথুসার বলছেন যে আইডিওলজি একটা বস্তুগত বিষয়।

কিন্তু, আমরা যে আইডিওলজিকে নেহাতই চিন্তার বিষয় বা ভাবজগতের বিষয় ভাবি, সেটা কেন?

এমন ভাবাটা নিজেই আইডিওলজির ফলাফল! বলা যায় যে এটা আইডিওলজি সম্পর্কে ধারণার একটা আইডিওলজিক্যাল বিকৃতি—একটা বিশেষ আইডিওলজিতে থাকলেই আইডিওলজি সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করা সম্ভব। আর এমন ধারণা পোষণ করার ফলাফল হল, আমরা মনে করি যে আমরা স্বাধীনভাবেই, কোনো বাহ্যিক প্রভাব বা জোর-জবরদস্তি ছাড়াই বিভিন্ন মতবাদ, চিন্তাধারা ইত্যাদিতে বিশ্বাস স্থাপন করি। কারণ, আমি বিভিন্ন চিন্তা আর ধারণাকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক করতে পারি বলে আমার মনে হয় যে আমি একজন সচেতন সত্তা যার কিনা এসব ধারণার ওপর স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ আছে।

ফলে আমি যখন একটা চিন্তাধারাতে আস্থা স্থাপন করি, সেটাকে নিজের ফ্রি উইল বা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ফলাফল হিসাবেই উপলব্ধি করি। আর তাই, এসব চিন্তাধারার সাথে সংশ্লিষ্ট প্র্যাকটিসগুলি আমি খুবই নিষ্ঠার সাথে পালন করতে উদ্বুদ্ধ হই। যেমন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া। আর ঠিক এর মাধ্যমেই আইডিওলজিকে বস্তুগত করে তুলি। বা, সঠিকভাবে বললে, এভাবে আদতে আইডিওলজি নিজেকে বস্তুগত করে তোলে, আমাদের মাঝে একটা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ভ্রান্তি তৈরির মাধ্যমে।

৮.
চিন্তাধারাতে বিশ্বাস স্থাপন করা আর সেই অনুযায়ী প্র্যাকটিস করে আইডিওলজিকে বাস্তব করে তোলা দুইটা পরস্পর সর্বসম ঘটনা, কারণ দ্বিতীয়টা প্রথমটার নেসেসারি কনসিকুয়েন্স বা আবশ্যক ফলাফল। এভাবে বিষয়টাকে ভাবা যায় যে আমি যদি কোনো ধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করি, সেটার প্রমাণ হল আমি সেই ধর্মমত অনুযায়ী উপাসনা বা অন্য কোনো আচার পালন করব। আমি যদি পালন না করি, সেটা উলটে আমার বিশ্বাসকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে যে আমি সম্ভবত ভাল বিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারিনি বলেই ধর্মীয় আচার পালন করতে পারিনি।

প্র্যাকটিসই এভাবে চিন্তার মূল্যায়ন করে। আমরা আইডিওলজি অফ আইডিওলজিতে আক্রান্ত বলে এই চিন্তা আর প্র্যাকটিসের মধ্যে একটা সময়-জনিত ব্যবধানকে প্র্যাকটিসের ওপর চিন্তার প্রাধান্য হিসাবে ভেবে নেই। মানে যেহেতু আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি যে কোনো কাজ করার আগে আমরা সেই কাজের বিষয়ে চিন্তা করি, তাই আমাদের মনে হয় যে চিন্তাই সম্ভবত কাজের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে। কিন্তু আদতে চিন্তা যদি প্র্যাকটিস না আনে তবে চিন্তাই শূন্য প্রমাণিত হয়—আমি ভাবি যে শুরু থেকেই আমার চিন্তায় নিষ্ঠার ঘাটতি ছিল, যেমনটা ওপরের উদাহরণে দেখা যাচ্ছে। প্রাধান্যটা এখানে স্পষ্টতই প্র্যাকটিসের। আইডিওলজির অস্তিত্বও তাই আমাদের কাজে, বস্তুজগতের সাথে আমাদের মিথস্ক্রিয়ায়। আমাদের চিন্তায় না।

আইডিওলজির এই স্বভাব ব্যাখ্যা করতে আলথুসার খ্রীষ্টান দার্শনিক ব্লেইজ পাসকালের বেশ আকর্ষণীয় একটা উক্তি উল্লেখ করছেন (আসলে পাসকাল যা বলতে চেয়েছেন আলথুসার সেটাকে কিছুটা বিকৃত করেছেন, তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না এখানে)। যারা ধর্মে অবিশ্বাসী, তাদের প্রতি পাসকালের উপদেশ এরকম—“হাঁটু গেড়ে বসো, প্রার্থনায় মন দাও, একসময় দেখবে যে তুমিও বিশ্বাস করা শুরু করেছ।”

আলথুসার বলছেন যে আইডিওলজি একদম এইভাবেই ফাংশন করে। আমি যখন ছোটকালে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে দাঁড়াই তখন হয়ত আমি বুঝিও না যে আমি কেন এটা করছি বা গানের কথাগুলির অর্থই বা কী। কিন্তু ঠিক এভাবেই ধীরে ধীরে আমি রাষ্ট্রের একজন অনুগত নাগরিক হয়ে উঠি, আর মনে করি যে আমি এই নাগরিক পরিচয়কে স্বেচ্ছায় ধারণ করে আছি। এইভাবেই আইডিওলজি অফ আইডিওলজিতে প্র্যাকটিস নিজেই আইডিওলজিকে বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে চিন্তার প্রাধান্যের ভ্রান্তি তৈরি করে।

এখন আমরা পৌঁছাই আইডিওলজি বিষয়ে আলথুসারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায়—ইন্টারপেলেশন (Interpellation). ইন্টারপেলেশনের ধারণা প্রস্তাব করার মাধ্যমে তিনি একইসাথে সাবজেক্টের (Subject) ধারণাকে আইডিওলজির অঙ্গীভূত করে ফেলেন। সাবজেক্ট হল আইডিওলজির একক। সাবজেক্টের ওপর আর সাবজেক্টের মাধ্যমেই আইডিওলজি কাজ করে।

ইন্টারপেলেশনের মাধ্যমে আসলে একজন ইন্ডিভিজুয়াল বা একক ব্যক্তি একজন সাবজেক্ট হয়ে ওঠে। একজন ইন্ডিভিজুয়ালকে প্রতিক্ষণে ইন্টারপেলেশনের দ্বারা সাবজেক্ট বানিয়ে রাখাই আইডিওলজির ফাংশন। বলা চলে যে আইডিওলজি নিজে এই ফাংশন ব্যতিরেকে অন্য কিছুই না। সাবজেক্ট তাই সবসময়ই আইডিওলজিক্যাল সাবজেক্ট।

এমনকি “আইডিওলজিক্যাল সাবজেক্ট” বলাটাই বাহুল্যদোষ। আলথুসার এখানে খুব সুন্দর করে বলছেন—”Man is an ideological animal”, অর্থাৎ, মানুষ একটা আইডিওলজিক্যাল প্রাণী। আইডিওলজির সাথে সাবজেক্ট ক্যাটাগরিটার সম্পর্ক আমরা বুঝতে পারি পুঁজিবাদে এসেই। পুঁজিবাদেই সাবজেক্ট ক্যাটাগরিটাকে এত স্পষ্ট ভাবে বোঝা সম্ভব হয়, যেভাবে আলথুসার ইন্টারপেলেশনের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছেন। শুধু সামন্তবাদের, কিংবা শুধু দাসব্যবস্থার বিশ্লেষণে এইসব ব্যবস্থায় সাবজেক্টের ভূমিকাকে ঠিক নির্দিষ্ট করে বোঝা সম্ভব হয় না। শুধু পুঁজিবাদে এসেই তা সম্ভব হয়। কিন্তু এটাই সমগ্র ইতিহাসজুড়ে আইডিওলজিতে সাবজেক্ট ক্যাটাগরিটার কেন্দ্রীয় ভূমিকা স্পষ্ট করে।

অর্থাৎ পুঁজিবাদে এসেই সামন্তবাদ আর দাসব্যবস্থায়ও কীভাবে সাবজেক্ট ক্যাটাগরিটা কাজ করত সেটা আমরা বুঝতে পারি। আবার শুরুতেই আমরা দেখে এসেছি যে আইডিওলজির কোনো ইতিহাস নেই। ফলে আইডিওলজির কেন্দ্রে থাকা এই সাবজেক্ট ক্যাটাগরিটারও কোনো ইতিহাস নেই। সাবজেক্টের এই কেন্দ্রীয় ভূমিকাটাও Omni-historical, যদিও তা বুঝতে পারা যায় পুঁজিবাদে এসে।

এই সাবজেক্ট কখনও টের পায় না যে সে একটা আইডিওলজিক্যাল সাবজেক্ট, ফলে সাবজেক্ট হওয়ার প্রাথমিক শর্ত হল একটা “বিস্মৃতি”, সে যে আইডিওলজিতে আবদ্ধ সেটা ভুলে থাকা। আর এটাই আইডিওলজির সবচেয়ে মৌলিক ফাংশন, আইডিওলজি অফ আইডিওলজির প্রভাব।

৯.
বিষয়টা একটা উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়—একটা শব্দ শোনা মাত্রই আমাদের মনে তার অর্থ ভেসে ওঠে, কিন্তু এই শোনা আর ভেসে ওঠার একটা পূর্বশর্ত হিসাবে কাজ করে এই ধারণা যে প্রত্যেক শব্দেরই একটা অর্থ থাকবে। যেমন কোনো নতুন শব্দের বা ভিন্ন ভাষার শব্দের অর্থ আমি না জানলেও এই বিশ্বাস আমার ঠিকই থাকে যে এর কোনো না কোনো অর্থ নিশ্চয়ই আছে।

এই ধারণাটা আমরা সচেতনভাবে ধারণ করি না, শব্দ শোনা আর অর্থ ভেসে ওঠার মাঝে কোনো পর্যায়েই এই ধারণাটা আমাদের সচেতন মনে আসে না, এটা “বিস্মৃত” থাকে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ থেকে আমরা বুঝি যে এমন একটা ধারণা সচেতনের পিছনে অচেতনে ক্রিয়াশীল আছে—যার প্রভাবেই সেই শব্দ শোনা আর তার অর্থটা ভেসে ওঠা একেবারেই তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে। আইডিওলজিও সেই অচেতন পর্যায়েই কাজ করে, সচেতনতার অতীত একটা জায়গায় সচেতনেরই ভিত্তি হিসাবে—একটা বিস্মৃতির মত।

আইডিওলজির এই কাজ করাটাকে আলথুসার বলছেন একটা রিকগনিশন ফাংশন (Recognition function), মানে স্বীকৃতি দেওয়ার বা পরিচয় দেওয়ার ফাংশন। আলথুসার একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন–

ধরুন আপনি রাস্তায় হাঁটছেন, অনেকেই হাঁটছে। এমন সময়ে পিছন থেকে একজন পুলিশ ডেকে উঠল “এই যে, আপনি, দাঁড়ান!” আপনি এই ডাকটা শুনবেন, আর সাথে সাথেই বুঝে যাবেন যে আপনাকে উদ্দেশ্য করেই ডাকটা দেওয়া হয়েছে। আপনি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে তার দিকে তাকাবেন, আর এই ১৮০ ডিগ্রি ঘোরার মধ্য দিয়েই আপনি ইন্টারপেলেটেড হয়ে গেলেন।

এখানে ধরে নিলাম আপনি হয়ত এমন কিছু করেছেন যার কারণে পুলিশ আপনাকে থামাতে পারে বা আপনার মনে এমন কোনো অস্বস্তি আছে বা শঙ্কা আছে যার কারণে আপনি পুলিশের ভয়ে কিঞ্চিৎ ভীত। পুলিশের ওই বেনামি ডাকের উদ্দেশ্য হিসাবে নিজেকে উপলব্ধি করার মাধ্যমেই আপনি একজন ইন্ডিভিজুয়াল থেকে একটি সাবজেক্ট হয়ে উঠলেন, যে আইনের কাছে দায়বদ্ধ, সমাজ আর রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ। পুলিশের ডাকে সাড়া দেওয়াটা আপনার এই দায়বদ্ধতার একটা বহিঃপ্রকাশ।

এখন মনে হতে পারে যে ডাকে সাড়া দেওয়াটা তো স্বাভাবিক বিষয়, এটা আইডিওলজিক্যাল কীভাবে? কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এই বিষয়টা শুধুমাত্র আপনার মনে থাকা আশঙ্কা বা ভয় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ রাস্তায় হাঁটতে থাকা অতগুলি মানুষের প্রত্যেকের মনেই কিছু না কিছু অস্বস্তি ক্রিয়াশীল আছে। কারো মনই তো একেবারে নির্মল না। এতগুলি লোকের মধ্যে পুলিশের ডাক শোনার সাথে সাথেই শুধু আপনিই সেই ডাকের প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।

বাস্তবেও আমরা দেখি যে অধিকাংশ সময়েই এই ডাকে যে সাড়া দেয়, আসলেও তাকেই ডাকা হয়েছিল। বাকিদের কেউ ঘুরে তাকালেও সেই ঘুরে তাকানোটা কৌতূহলবশত, ডাকের উদ্দেশ্য হিসাবে নিজেকে শনাক্তকরণের প্রতিক্রিয়া না।

এই উদাহরণটা খুবই নির্দিষ্ট একটা উদাহরণ ছিল, শুধু যে ডাকের মাধ্যমেই ইন্টারপেলেশন ঘটে এমন না। উচ্চপদস্থ কাউকে দেখে তার প্রতি যে সম্মানের ভাব চলে আসে সেটাও আপনার ইন্টারপেলেশন, বা চাকরির পরীক্ষায় ভাল ফলাফল আনার জন্য কষ্ট করা, সেটাও। উপাসনালয়ে যখন ভিন্ন ভাষায়, যেই ভাষা আমি বুঝি না, কোনো কিছু উচ্চারিত হচ্ছে, কিন্তু আমি সর্বান্তকরণে জানি যে যা’ই বলা হচ্ছে তার উদ্দেশ্য আমি, সেটাও ইন্টারপেলেশন।

আরেকটা বিষয় হল, আলথুসারের ওই উদাহরণে ইন্টারপেলেশনের ঘটনাটাকে একটার পর আরেকটা—আগে ডাক, এরপর উপলব্ধি—এভাবে ক্রমানুসারে দেখানো হলেও সেটা শুধু বোঝার সুবিধার্থে। আসলে এই সবগুলি একইসাথে ঘটে, বলা চলে যে এগুলি সময়ের বাইরে ঘটা ঘটনা, তাৎক্ষণিক। আরো ভালভাবে বললে, পুলিশের ডাকা, আমার সাড়া দেওয়া, ইন্টারপেলেটেড হওয়া, আইডিওলজির অস্তিত্ব—এইসব একটাই ঘটনা, একবচন। এগুলি “ঘটনাবলি” বা বহুবচন না।

এই তাৎক্ষণিকতা থেকে আরেকটা বিষয়ও প্রতীয়মান হয় যে আইডিওলজির ইতিহাস না থাকার মতই আইডিওলজির কোনো “বাহির” নেই—যা ঘটে তা সবসময় আইডিওলজির মধ্যেই ঘটে। তাই এটাও বলা যায় যে আইডিওলজি নিজে এই “বাহির” ছাড়া অন্য কিছুই না, যেভাবে সমগ্র ইতিহাস জুড়েই আইডিওলজির বিস্তার।

১০.
আইডিওলজি নিয়ে আলথুসারের আলোচনা মূলত এটাই। পুরো আলোচনাটার সারসংক্ষেপ এই—আইডিওলজি মানুষের সাথে তার পারিপার্শ্বিকের সম্পর্ক রচনা করে। বিভিন্ন অ্যাপারেটাসের বিভিন্ন প্র্যাকটিসের মধ্য দিয়ে এই আইডিওলজি ক্রিয়াশীল হয়। আইডিওলজির অস্তিত্ব মূলত মানুষের কাজে, বা প্র্যাকটিসে। প্র্যাকটিসের মাধ্যমেই মানুষ বস্তুজগতে হস্তক্ষেপ করে, ফলে আইডিওলজির অস্তিত্বটাও বস্তুগত। আইডিওলজি মানুষকে বিভিন্ন পরিচয় দান করে ইন্টারপেলেশনের মাধ্যমে, তাকে ব্যক্তি থেকে সাবজেক্ট করে তোলার মাধ্যমে। মানুষের অচেতনের পর্যায়ে ক্রিয়াশীল হয়ে মানুষের যাবতীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তি হিসাবে আইডিওলজি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে।

আইডিওলজির একটা সাধারণ তত্ত্ব দাঁড় করাতে গিয়ে আলথুসার মার্ক্সকে অতিক্রম করে গিয়েছেন, কিছু জায়গায় মার্ক্সের প্রস্তাবের খণ্ডনও করেছেন। তার আইডিওলজির তত্ত্ব শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ব্যবহার্য না, যেমনটা মার্ক্সের, বরং আলথুসারের তত্ত্বটা মানুষ হিসাবে জগতের সাথে আমাদের সম্পর্ক আর যেকোনো ধরনের মিথস্ক্রিয়ারই একটা মৌলিক ব্যাখ্যা প্রদান করে। এসব দিক বিবেচনায় অনেকে তাই এই তত্ত্বকে “পোস্ট-মার্ক্সিস্ট” বলতে চেয়েছেন।

আলথুসারের তত্ত্বকেও স্বাভাবিকভাবেই অনেকে অতিক্রম করে গিয়েছেন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সমকালীন স্লোভেনিয়ান দার্শনিক স্লাভয় জিজেক। জার্মান দার্শনিক হেগেল ও ফরাসি সাইকোঅ্যানালিস্ট জ্যাক লাকাঁর চিন্তার নানা উপাদান প্রয়োগ করে জিজেক আইডিওলজির আরো সূক্ষ্ম এবং বিস্তৃত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। জিজেকের কাছে আইডিওলজি বিষয়টা হয়ে উঠেছে Ontological বা অস্তিতাত্ত্বিক। আশা করি, আইডিওলজি নিয়ে জিজেকের বিশ্লেষণ পরবর্তীতে আলোচনা করব।

ঢাকা, ২২ মার্চ ২০২৫