মুহম্মদ খসরু কোনো সিনেমা বানান নাই। কিন্তু তিনি মধ্যবিত্তের জন্য জরুরি চলচ্চিত্র আন্দোলন কইরা গেছেন।

বিশ্বের নানা দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা কইরা ও সেগুলি সম্পর্কে আলাপ আলোচনা তর্ক বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি কইরা তখনকার পোলাপাইনরে সিনেমা কীভাবে পশ্চিমবাংলা ও পশ্চিমের কথা মাথায় রাইখা বানাইতে হবে, তা শিখাইছেন।

বাংলাদেশের সিনেমা জগৎ থিকা ছোটলোক বহিষ্কারে তার অবদান শীর্ষস্থানীয়। তার আন্দোলনের ফলেই আজকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ছোটলোকদের হাত থিকা মিডল ক্লাসের হাতে গিয়া সমর্পিত হইতে পারছে।

মিডল ক্লাস আর্টিস্ট ও মোটিভেটর হিসাবে পরলোকগত খসরু ভাইয়ের বিরাট অর্জন এই জিনিস। এইটা এরশাদ, জিয়া ও খালেদা জিয়ার আমলে, তুলনামূলক ভারত অবান্ধব পরিবেশে সহজ কাজ ছিল না।

তবে এই কাজ আমার পছন্দের হয় নাই।

আমি মনে করি দুই শ্রেণীর জন্যে চলচ্চিত্রের দুইটা ধারা থাকতে পারত। এখনও পারে। এবং সিনেমার ক্ষেত্রে সত্যজিৎ, মৃণাল ও ঋত্বিক এদের একচ্ছত্র মিডল ক্লাস ‘চলচ্চিত্র নন্দন’ (হাঃ হাঃ) বর্জন করা দরকার।

কিন্তু আমার পছন্দ দিয়া তো ক্ষমতাবান মিডল ক্লাস ছোটলোকের বাসনে ভাত খাইতে বসবে না। না তারা মধ্যবিত্ত প্রমিত মায়েস্ত্রদের বাদ দিবে।

বড় কথা হইল, সে জন্যে তাদের দোষও দেওয়া যাবে না। যার যার ক্লাসের শিল্প-সাহিত্য চর্চা সে সে করবেই।

কাজেই সমালোচক ও নিন্দুকদের দেখতে হবে, খসরু তার কাজটা ঠিক মত কইরা গেছেন কিনা।

২.
এইখানে ছোট ফাঁকে বড় প্রশ্নটা রাখি। খসরু ভাই জাতে মিডল ক্লাস হইয়াও ছোটলোকের গালাগালি ও খিস্তি রপ্ত ও প্রচারে কেন মগ্ন আছিলেন? হোয়াই? হোয়াই তিনি মিডল ক্লাসরে গালাগালি মূলক ছোটলোকের মুখের ভাষা শিখাইতে তৎপর আছিলেন এত!

তিনি যদিও পশ্চিমবাংলার ওই তিন গ্রেটের আপাত গভীর সিনেমার প্রভাব এইখানে ছিটাইতে চাইছিলেন কিন্তু বাংলাদেশে পশ্চিমবঙ্গের আগ্রাসী মিহি সংস্কৃতির সঙ্গে তার খিস্তিখেউড়ময় অস্তিত্ব ছিল সাংঘর্ষিক। অর্থাৎ দুধে চোনা মিশতেছিল। তাই এইখানকার পরিচালকদের সিনেমায় ছহি পশ্চিমবাংলা—দুয়েকজন উগ্র প্রমিতবাদীরে বাদ দিলে—গৃহীত হয় নাই।

তো গালাগালি কীভাবে রপ্ত করছিলেন খসরু ভাই? মুহম্মদ খসরু নিজে সম্ভবত ছোটলোক ফ্যামিলি বা ফ্যামিলি পরিবেশ থিকা আসছিলেন। তার গালাগালি বা খিস্তির সাবলীলতা সেই বার্তা দেয়।

খসরুর জন্ম ইন্ডিয়ার পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়, ১৯৪৬ সালে। বাপদাদার নিবাস ছিল ঢাকার কেরানিগঞ্জে। হুগলি জুট মিলে কাজ করতেন খসরুর বাবা। আপনারা জানেন, জুটমিলের পরিবেশ মিডল ক্লাসের পরিবেশ নয়। ছোটলোকপ্রধান পরিবেশে চাইলেই আপনার ছেলে সন্তানকে গালাগালির বাইরে রাখতে পারবেন না। মিডল ক্লাস ভদ্রলোকের সন্তান হিসাবে ছেলেকে মানুষ করা কঠিন হইতে পারে আপনার জন্যে। বিশেষত আপনি যদি কারখানায় বেশি সময় দেন এবং বিশেষত আপনি যদি নিজের মধ্যে “ছোটলোক ঘৃণা” ও “মধ্যবিত্ত ভালবাসা” খুব কইরা ধারণ না করেন।

খসরুর তুলনায় আমি যদি নিজের কথা ভাবি, তবে দেখেন, আমার নিজের জন্ম ঢাকার বাড্ডায়। ষাইটের দশকে সরকারী চাকরিজীবীরা বেশির ভাগই আড়াই কাঠা তিন কাঠা জমি কিন্না বাড়ি করছে সেখানে। তখন সেইখানে, সত্তরের দশকে, ঢাকা শহর অতি ধীরে বাইড়া উঠতেছিল। গ্রাম ও শহর একই মঞ্চে ক্রিয়াশীল। আমার আব্বা ছিলেন এজিবির সরকারি চাকুরিজীবী। আমি তখন প্রাইমারিতে পড়ি। ছোট মিডল ক্লাস হওয়ার কারণে এবং সেই সময় সময়টাই ভিন্ন রকম ছিল বইলা আমরা ছোটলোকদের সঙ্গে মিশার অবারিত সুযোগ পাইছি। গালাগালিও শিখছি। বাসায়ও যে আমরা ভাইবোনরা পরস্পররে গালি দিতাম না এমন তো না। আপনারা যারা দেন না তাদের কথা আলাদা।

তো ১৯৫০-এর দশকে পশ্চিমবাংলায় দাঙ্গার টাইমে মুহম্মদ খসরুর বাবা ছোটলোকদের এলাকা ছাইড়া ঢাকায়, সম্ভবত কেরানিগঞ্জে, সম্ভবত গ্রামে, চইলা আসেন।

অর্থাৎ খসরু মিডল ক্লাস বলয়ে পরে ঢুকছেন। ফলে তার গালাগালির সংস্কৃতি বাদ দিতে পারেন নাই, মেবি চানই নাই বাদ দিতে।

কাজেই খসরুর গালাগালিরে যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্যে অভিশাপ বা নিতান্ত কলুষ আকারে দেখতেছেন আপনারা হাইব্রিড হিসাবে ঢাকার ব্রয়লার মুরগির খোপগুলিতে যে বাইড়া উঠতে বা মরতে থাকতেছেন তা অনুধাবনের আহ্বান জানাই।

পলিটিক্যাল কারেক্টনেস আর নারীবাদ আর ক্যানসেল কালচারের ফড়ফড়ি দিয়া গালাগালির বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়েন না। এইটাও ভাষাই। গালাগালি যদি ব্যক্তি আক্রমণ না ঘটায় তাইলে এইটা খুব ঠিক আছে। আবার রাজনৈতিক লড়াই হিসাবে ব্যক্তি আক্রমণও তো ঠিকই আছে!

৩.
শেষ জীবনে মুহম্মদ খসরু ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগে ভুগছেন। ভর্তি হওনের পরে হাসপাতালে নিউমোনিয়াও ধরা পড়ছিল। ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ২০১৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মারা যান মুহম্মদ খসরু। তার মৃত্যুর দিন বিকালে প্রথম আলো “চলে গেলেন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব মুহম্মদ খসরু” শিরোনামে নিবন্ধ প্রকাশ করে। সেখানে তারা জানায়:

“১৯৬৩ সালে ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মুহম্মদ খসরু। সৎ, শুদ্ধ ও নির্মল চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন, সেগুলোর পঠন-পাঠনের মাধ্যমে আস্বাদন, অনুধাবন ও উপলব্ধি করা, আলোচনা-সমালোচনা করা, চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ ও প্রচার, সর্বোপরি সমঝদার ও রুচিমান দর্শক তৈরির যে সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে, মুহম্মদ খসরু গত ৫০ বছর সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন।”

কাজেই বাংলাদেশী মিডল ক্লাসের সিনেমা কেমন হইতে পারে বা কী হইতে পারে না, বা কী হইছে, সেখানেও ৫০ বছরের প্রভাব ও অবদান খসরু ভাইয়ের।

এইটারে যারা ছোট কইরা দেখবেন তারা খসরু ভাইরে হেয় করতে অবশ্যই পারবেন “তিনি কেন সিনেমা বানান নাই” এই কাদুনি গাইয়া।

সিনেমা বানানো বা বই লেখা যে জরুরি না বরং চিন্তাই মূল, তা প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকও দেখাইয়া গেছেন। সিনেমা বা বই হইল রচয়িতাদের ফেটিশ। ফেটিশে দোষ নাই। কিন্তু কেন ফেটিশ নাই কারো, সে দোষ কাউরে দেওয়া যায় না।

৪.
খসরু ভাইরে আজকে যেমন লোকে অবহেলা অপমান করে সেইটা তার সেই সময়েও বর্তমান আছিল।

উনি যাতে সিনেমা বানাইতে না পারেন, যাতে টাকা পয়সা জোগার করতে না পারেন তার জন্যে তার শিষ্য-প্রশিষ্যরাও অ্যাকটিভ ছিল। তারা সর্বত্র “গালি দেওয়া লোক” হিসাবে খসরুর প্রধান পরিচয় তৈরি করছেন।

তাতে মিডল ক্লাস অর্থবানরা তারে বিশ্বাস করতে পারেন নাই, যেমন এখনকার ইন্টেলেকচুয়াল তরুণরাও তারে মিসলিডিং হিসাবে প্রচার করতেছেন।

৫.
শিল্পী-সাহিত্যিকদের বয়স হইলে যে তাদের কান্ধে শিল্পী-সাহিত্যিক তরুণ-তরুণীদের ল্যা ওড়া ও শা উয়া বহনের দায়িত্ব দেওয়া হয় এইটা ভয়ঙ্কর। খসরু ভাইরে দেখতে হবে জাস্ট আর্টিস্ট হিসাবে। লাইফ স্টাইল আর্টিস্ট ছিলেন তিনি। গালাগালি বা পরনিন্দা পরচর্চা তিনি যা করতেন সেইটা প্রকাশিত বা লিখিত ভাবে কখনোই ব্যক্তি আক্রমণের কাতারে পড়ে নাই। ব্যক্তিগত ভাবে বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে কেউ গালাগালি করে কিনা সেইটা ওই গোষ্ঠীরই ব্যাপার।

যারা খসরুর গালাগালি শুইনাও তার কাছে ভিড়ত খসরুর গালাগালির কারণে তাদের শিল্প সম্ভাবনা ভেস্তে গেছে—এমন চিন্তা অমূলক।

যাদের সম্ভাবনা পল্লবিত হইছে তারাও তো খসরুরে কাছ থিকা দেখছেন, তার কথা শুনছেন, তার গালাগালি শুইনা তৃপ্ত আছিলেন। না হইলে তো সঙ্গ পরিহারই করতেন, তাই না?

তার আন্দোলনের ভাই বেরাদরদের অনেকেই সিনেমা বানাইছেন, কুতুব হয়েছেন, যারা চাইলে অনেকেই, সম্ভবত তারেক মাসুদও, সম্ভবত মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও, খসরু ভাইরে পয়সা জোগার কইরা দিয়া সিনেমা বানাইতে সাহায্য করতে পারতেন।

তা কেউ করেন নাই।

৬.
খসরু যদি সিনেমা বানাইতেন তাইলে কেমন বানাইতেন সেই আলাপ একেবারেই গাছে কাঁঠাল ধরনের আলাপ। যারা অনেক ভাল সিনেমা বানাইছেন তারা হয়ত চলচ্চিত্র আন্দোলনে অশ্বডিম্ব প্রসব কইরা গেছেন, তেমন হইতেই পারে।

৭.
খসরুর গালাগালি ছিল পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা থিকা প্রভাবিত হইয়া বাংলাদেশের সিনেমা বানানিওয়ালারা যাতে রবীন্দ্রগিরি অর্জন না করতে পারে তারই ভেদরেখা।

এই ভেদরেখা তার সচেতনতা দিয়া তৈরি হয় নাই। বরং তার সরলতার কারণেই তা ঘটতে পারছে। এই সরলতা শিল্পী বা আর্টিস্টের মহত্তের জায়গা। যেইটা বেসিক।

মুহম্মদ খসরুর সঙ্গে লেখক, ছবি তীব্র আলী, নভেম্বর ২০১৩

এইখানকার যারা খসরু ভাই সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাদের সিনেমা ও নাটক দেখলে রবীন্দ্রগিরির সাথে তাদের সেই ফারাকটা আমরা অনুধাবন করতে পারি।

২০ বছর বয়সে তিনি চলচ্চিত্র আন্দোলন শুরু করছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই কাম কইরা গেছেন। এইটারে স্রেফ “চলচ্চিত্র সাহিত্য” বইলা উড়াইয়া দেওয়াটা খসরুরে সীমিত কইরা দেখা।

মুহম্মদ খসরু যে-সিনেমা বানান নাই সেই সিনেমার জন্যে তারে প্রশংসা করতে বলি না। কিন্তু সেই না-বানানো সিনেমার কারণে তার চলচ্চিত্র আন্দোলনরে কেন গৌণ কইরা দেখতেছেন?

২০/২/২০২৩