মাঝে মাঝে মনে হয় আমার মাথার ভিতরে একটা রেইস চলতেছে। এত তথ্য, এত ঘটনা, এত খবর, দুনিয়া বাই-বাই করে ঘুরতেছে আর আমার মগজে ট্রাফিক জ্যাম লেগে যাচ্ছে। একটা অস্থিরতা ঘুরপাক খাইতে থাকে। কত কিছু করতে হবে, কত কিছু বলতে হবে, কত কিছু লিখতে হবে! কত কেউ ভুল বুঝতেছে, ভুলভাল বলতেছে। এদের জবাব দিতে হবে। এই অস্থিরতার চোটে কিছুই করা হয় না। সবকিছুতে তাড়াহুড়া।

মাঝে মাঝে অসুখ হওয়া ভাল। গত কয়েক সপ্তাহে মাঝে মাঝে এমন হইছে যে ব্যথার চোটে সোজা হয়ে বসতেই পারতেছি না। এই সময়গুলাতে মনে হয় হাঁটার সময় একটা পা ফেলার পরে, আরেকটা পা ফেলাই বিরাট সফলতা। একবেলা ঠিকঠাক সোজা হয়ে টেবিলে বসতে পারাটাই আনন্দের মনে হয়। মাথার ভিতরের দৌড়ঝাপ থেমে যায় তখন। ঘুর্নিঝড় শেষে শান্ত বিষণ্ণ পারিপার্শ্বিকের মতন মন হয়ে থাকে। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে তাকায়েই থাকা যায়। সেখানে মাঝে মাঝে বাতাসে ডালপালায় মৃদু দোলা লাগে। কখনো দুই একটা পাখি এদিক ওদিক যায়। ব্যাকইয়ার্ডের গাছগুলাতে ফুল আসতে শুরু করছে—বাদাম ফুল, প্লাম ফুল, আপেল ফুল, লেবু ফুল।


লুনা রুশদী


মাঝে মাঝে যখন দুই এক পা ঘুরে আসি উঠানে, ফুলের পাপড়ি বৃষ্টির মতন ঝরে বাতাসে, এক গাছ থেকে উড়ে গিয়ে অন্য দূরের গাছের তলায় লুটায়ে পড়ে। কেউ কেউ বাড়ির বাউন্ডারি পার হয়ে অন্যবাড়িতে পৌঁছায়। ওদেরকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করি যতদূর দৃষ্টি যায়। শ্বাস নেই, শ্বাস ফেলি। ফুল আর ধূলার গন্ধভরা বাতাস আমার শরীরে ছড়াইতে থাকে।

লুনা রুশদী
করোটিয়া, সাদত কলেজে প্রিন্সিপালের বাড়িতে।

মাঝে এক সপ্তাহ অফিস যাই নাই। কয়েক সপ্তাহ ধরে যাইতেছি আবার। দুপুরে হাঁটতে বের হই। আস্তে আস্তে, যতটুকু সহ্য হয় ততটুকুই। বসন্ত আসছে এই শহরে। ক্যাম্বারওয়েলে এখনও অনেক পুরানো বাড়ি। কিছু বাড়ি আছে ইউরোপিয়ান ধাঁচের। শান বাঁধানো রাস্তার দুই পাশে ঘাস আর যত্নে ছড়ানো মৌসুমি ফুলের গাছ। গাড়ি বারান্দা। বাগান বিলাসের লতানো ডাল উঠে গেছে কাঠের বা লোহার ফ্রেম বেয়ে। কোনো বাড়ির গাছে ভর্তি করে ম্যাগনোলিয়া। রাস্তার পাশের ফুটপাথের বুনো গোলাপের চারাগুলাতে আবার পাতা আসছে, ফুল ফুটতেছে। মেপল গাছে কচি পাতা আসতেছে। এইসব দেখি।

গতজন্মের স্মৃতির মতন ছোটবেলা মনে পড়ে। টাঙ্গাইলে নানার বাড়ির উঠানে, বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির সাথে দুইটা মুখোমুখি সিমেন্টের বেঞ্চ ছিল। লাল রঙ করা, সেই রঙ আমাদের সময় পর্যন্ত আসতে আসতে হালকা গোলাপী হয়ে গেছিল। ছোটবেলা থেকেই আমরা দেখতাম রঙ ওঠা সিমেন্টের বসার জায়গা, একটা সোঁদা মাটি মাটি গন্ধ আসত সেখানে বসলে।

লুনা রুশদী
করোটিয়া, সাদত কলেজ, প্রিন্সিপালের বাড়িতে, একদিকে বাচ্চু, আরেক দিকে বিরু।

আমার ইয়ার ফোনে কত রকম গান বাজে… “মহব্বত মে নেহি হ্যায় ফার্ক জিনে অওর মারনে কি, উসি কো দেখ কার জিতে হ্যায় জিস কাফির পে দাম নিকলে…” কত রকম প্রেম মনে আসে, কত রকম মৃত্যু। কোনো বাড়ির সামনে কয়েকজন বসে আড্ডা দেয়, কোথাও কোনো প্রৌঢ় বা বৃদ্ধা বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে, হাসি বিনিময় করে কারো সাথে।

নিজেকে যে এত অপরিহার্য মনে হয়, এইটা আসলে কেমন? কেন হয় এইরকম? আমরা একটা ঘোরের মধ্যে থাকতে চাই বোধহয়। কোনো একটা ইস্যু নিয়ে আমি কিছু যদি না বলি, দুনিয়া কি থেমে যাবে? আমারে কেউ যদি ভুল বোঝে, মনে মনে গালি দেয়, কী আসে যায়? আমার কেন এত রিয়্যাক্ট করা লাগে? আশির দশকের দুপুরগুলায় ফিরতে ইচ্ছা করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় বসে বসে বই পড়তাম, বাইরে রিকশা চলত, সেটাও একটা ঘুম ঘুম ছন্দে। তখন সোশাল মিডিয়া ছিল না। দুনিয়ার এত খবর না জানলেও চলতো… জুলাইয়ে মৃত ছেলেমেয়েগুলার জন্য একটা কান্না কাঁপতে থাকে মনের ভিতরে। ওদের কবরে কি ঘাস হইছে এখনও? প্রতিদিন কেউ না কেউ যে মারা যাচ্ছে হাসপাতালে, তারপরে তাদের আত্মা কই যায়? ওরা কি বাতাসে বাতাসে ঘুরতে থাকতেছে?

এই যে আমরা কেউ কাউরে সইতেই পারি না আর। আরেকজনের বাড়িতে গিয়ে দখল করার অধিকার নাই। এই যে সোশাল মিডিয়ার যুগ, কত রকম কমুনিকেশন, কত রকম অ্যাপ, অথচ আমরা কেউ কাউরে চিনি না। আমরা একটু শুনি না আরেকজনের কথা… আমাদের আত্মার সাথে আত্মার যোগাযোগ নাই। বাইনারি থেকে বেরই হইতে পারলাম না, যে বাইনারির থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বাচ্চাগুলা মারা গেল… আমরা কবে সামনের মানুষটার দিকে ঠিকঠাক দেখব?

অসুখ হওয়া ভাল, অসুখ হইলে মনে হয় কী হবে কিছু বলে? মনে হয় আমি আর কতদিন? এই তো মাটির সাথে, ধূলার সাথে মিশে যাব। আমার কবরের উপরেও ঘাস গজাবে। কখনও বাতাসে উড়ে আসবে ফুলের পাপড়ি। বাতাস বইবে ঘাসের উপর দিয়ে। তখনও চাঁদ উঠবে মাঝে মাঝে… আমি কোথাও থাকব না।

পড়ন্ত বিকালে আম্মার বাগানের এক গাছের সাথে আরেক গাছ জড়াজড়ি করে বাড়তেছে। একজন আরেকজনের খুঁটি। এবারের বসন্তকালটা ভীষণ বিষণ্ণ। যেন ফুলগুলিও ফুটতে ফুটতে ঝরা ফুলের স্মৃতি ভুলতে পারতেছে না। ওদের আগে আরো কোটি কোটি বছর ধরে যারা ঝরে গেছে ওদেরকে জায়গা করে দেয়ার জন্য, যেন তাদেরকে অস্তিত্বে মিশায়ে নিয়ে ফুটতেছে তারা। প্রতিটা নতুন ফুল ফুটলে, প্রতিটা পাতা কুঁড়ি ছাড়লে… আমার একদম হাড্ডির ভিতর থেকে…রক্তের মধ্যে থেকে কান্না উঠে আসে।

আমার জন্মের সময়ে নাকি অনেক বৃষ্টি ছিল, ঝড় ছিল। আব্বা তখন করটিয়া সাদাত কলেজের প্রিন্সিপাল। কলেজে কিছু ঝামেলা চলতেছিল। সেইসব ঝামেলা মিটানোর দরবার করার জন্য ঢাকায় যাইতে হইছিল সেদিন তার।

আম্মা করটিয়ার গল্প করার সময় আমি চোখের সামনে সেই সময়ের আব্বাকে দেখি—কখনও বিকালে কলেজের মাঠে ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলতেছে, কখনও কলেজের পুকুর পরিষ্কার করায়ে মাছের চাষের তদারকি করতেছে, বা কলেজের জমিতে গাছ লাগানো এবং বিভিন্ন চাষাবাদের ব্যবস্থা করতেছে যাতে এই সমস্ত বিক্রির টাকায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড খোলা যায়।

সে সময়কার বহু দুর্ধর্ষ কাহিনী আছে। যেমন একবার আমাদের বাসায় ডাকাতি হইছিল, আব্বা-আম্মার কাছে থেকে লেখাপড়া করত আব্বার বন্ধুর ভাই—দেলু মামা। ডাকাতরা নাকি আব্বার নাগাল না পেয়ে দেলু মামাকে বেঁধে ফেলে রেখে গেছিল। অন্য একদিন একদল ছেলে মিছিল করে আব্বার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দিতে এসে বাসা ঘেরাও করে ফেলল। আব্বা তাদের সামনে দাঁড়ায়ে কিছুক্ষণ কথা বলার পরে তারা জিন্দাবাদ দিতে দিতে ফেরত গেছে। আরেকবার একটা ছেলে রিভলভার নিয়ে আসছিল আব্বারে খুন করতে। কিন্তু আব্বা এত আন্তরিক আর সুন্দরভাবে তার সাথে কথা বলছিল যে, ছেলেটা যাওয়ার সময় আব্বাকে তার রিভলভারটা দিয়ে যেতে চাইছিল নিরাপত্তার জন্য। আব্বা তখন তারে বলছে, “দুনিয়ায় এমন কোনো অস্ত্র নাই, এমন কোনো আশ্রয় নাই যা আমাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবে।” আমার এখনকার ৭৯ বছর বয়সী বাবা—যে লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারে না, সোফায় বসে ঘুমায়ে যায়, অল্পতেই বিচলিত, হিসাবী এবং অভিমানী মানুষটার মধ্যেই সম্পূূর্ণ বিপরীতধর্মী ত্রিশ বছর বয়সী মানুষটাও আছে।

আম্মাকে ভর্তি করা হইছিল মির্জাপুর হাসপাতালে। এমনিতেও সেটা ভাল হাসপাতাল, তার মধ্যে করটিয়া সাদাত কলেজ ওই অঞ্চলের নামকরা প্রতিষ্ঠান আর আব্বা সেই কলেজের প্রধান; এইজন্য আলাদা খাতির ছিল। সবচেয়ে ভাল রুমে সবচেয়ে আদর-যত্নে তারে রাখা হল। কথা ছিল, আব্বা ঢাকা থেকে কাজ সেরে হাসপাতালে আম্মাকে দেখে তারপরে করটিয়া ফিরবে। কিন্তু হাসপাতালের ঘরে সেই বিশ-একুশ বছর বয়সী হবু আম্মার মন তো টিকে না। এর আগে তার একটা ছেলে হইছিল লন্ডনের হাসপাতালে। সেই হাসপাতালের সেবা-যত্ন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে মাত্র কয়েক বছর আগে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের হাসপাতালের আকাশ-পাতাল ফারাক।

আব্বা আম্মা, লণ্ডনে রিজেন্ট পার্কে।

লন্ডনের জীবন আম্মার ভাল লাগত। এখনও যখন আমাদের মেলবোর্নের বাড়ির বসার ঘরে বসে বসন্তের বিকালে আমরা ইউটিউবে শুনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান “কপোতের বুকে ওই কত সুখে কপোতী ঘুমায়, লীলাছলে বনলতা কি সোহাগে তরুরে জড়ায়”—আম্মা বর্ণনা করে তাদের লন্ডনের বাড়ির জানালায় তুষার ঝরা কোন দিনের, যখন সামনের বাড়ির কার্নিশে জড়াজড়ি করে বসে থাকত একজোড়া কবুতর আর গ্রুন্ডিগ লং প্লেয়ারে বাজত এই গান। সে জীবন তার ছেড়ে আসতে হইছে আব্বার কারণে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আব্বা আর বিদেশে থাকতে চায় নাই, নিজের দেশের কাজে লাগতে চাইছিল।

চট্টগ্রামে, সদ্য লণ্ডন ফেরত আব্বা, তার শিশুপুত্র শিবলীর সাথে।

তাই ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে মাত্র কয়েক মাস বয়সের শিশুপুত্রকে নিয়ে তারা বাংলাদেশে ফিরছিল। তাদের প্রথম সন্তান, আমার অদেখা বড়ভাইয়ের নাম ছিল শিবলী আহমেদ রুশদী। সে জন্মানোর পরে আব্বা-আম্মা পরস্পরকে সম্বোধন করত শিবলীর বাপ এবং শিবলীর মা বলে। আমার ভাই আর এই দুনিয়ায় নাই, সেই ডাকটুকু রয়ে গেছে। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে তার প্রথম জন্মদিন বাংলাদেশে পালন করা হইছিল অনেক ধুমধামে, পরিবারের সবাইকে নিয়ে। সেই জন্মদিনে আমার বড়মামা তাকে একটা খেলনা হাঁস উপহার দিছিলেন, সেই হাঁস পেয়ে সে নাকি খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে বিছানার কাঠের বেড হেড ধরে ধরে হাঁটতেছিল…।

কয়েকদিন আগে ভোররাতে ল্যাপটপ নিয়ে বসছিলাম। বাইরে অন্ধকার। বাতাসের ঝাপটায় জানলা কাঁপতেছিল আর বৃষ্টির ছাঁট এসে বাজতেছিল কাচে। নিচতলায় আম্মা-আব্বার শোয়ার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ওদের ঘুমন্ত নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ পাইতেছিলাম। আমি জানালার অন্ধকারের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতেছিলাম টলোমলো পায়ে এক দুই পা হেঁটে বিছানায় ঝুপ করে পড়ে গিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকা শিশুর উল্লাস, তার কৌতূহলে আলোকিত হয়ে আছে হলুদ রঙের প্লাস্টিকের হাঁস। মুগ্ধ হয়ে দেখি সতেরো বছরের প্রায় কিশোরী আম্মা ঘরোয়া ঢঙে একটা সুতির শাড়ি পরে খোলা চুলে খাটের স্ট্যান্ডে হেলান দিয়ে বসে পরম মমতায় অবাক চোখে দেখতেছে সেই অলৌকিক খেলা। আমার চোখের পানি উপচায়ে পড়ে ল্যাপটপের কি-বোর্ড মাখামাখি… এই গল্পের পরিণতি আমি জানি, এর মাঝের হাহাকারটুকু আমাদের দৈনন্দিনতায় জড়ানো। যাকে আমি ইহজনমে দেখি নাই তার স্মৃতিতে আমার অন্তরাত্মা তোলপাড় করে।

জন্মদিনের চার দিন পরে ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্ব্বর আমার ভাই মারা গেছে তেজষ্ক্রিয় বেবিফুড থেকে ফুড পয়জনিং হয়ে। যে বয়সে মৃত্যু সম্পর্কে কোনো বোধই তৈরি হয় না, সেই বয়সেও কেউ যখন জানতে চাইত আমরা কয় ভাইবোন, আমি সবসময় বলতাম, “এক ভাই, তিন বোন। আমার ভাই এক বছর চার দিন হয়ে মারা গেছে।” সে বয়সেই আমি ‘তেজষ্ক্রিয়’ শব্দটা জানতাম কারণ হাজার হাজার বার এইভাবেই আমার বাবা-মা তাদের ছেলের গল্প বলছে। তার মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে একই দিনে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী নিধন হইছে, সেই সামষ্টিক-রাজনৈতিক অথবা রাষ্ট্রীয় শোকের সাথে জড়ায়ে গেছে আমাদের ঐকান্তিক সাদামাটা পারিবারিক শোক, অথচ তার তীব্রতা কিছু কম হয় না।

এরপর দিন, রাত, মাস, বছরের দীর্ঘ নিস্তব্ধতা, শূন্যতা পার করে যেভাবে হলুদ হয়ে যাওয়া ঘাসের মাঠে আবার জন্মায় সবুজ ঘাস, গাছের শুকায়ে যাওয়া ডালে যেভাবে ফিরে আসে সবুজ পাতার আভাস, নতুন আনন্দের সম্ভাবনা নিয়ে আমি আসছি আম্মার শরীরে। কত প্রতীক্ষার পরে আমি তাদের জীবনে আসছি জানাইতে কখনও কার্পণ্য করে নাই আব্বা-আম্মা। আর করোটিয়াতে ছিলামও রাজকন্যার মতন—ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কলেজের বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীদের কোলে কোলে। ছাত্রীরা নাকি আমাকে তাদের হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে চোখে কাজল, হাতে চকলেট দিয়ে ফেরত পাঠাত।

তো সেই দিন মির্জাপুরের হাসপাতালে থাকতে মোটেই ভাল লাগতেছিল না আম্মার। আব্বাও ঢাকায়। সে সময় তো আর যখন তখন ফোন করা যাইত না, এদিকে সে ছটফট করতেছে ওইখান থেকে বের হওয়ার জন্য। এমন সময় আম্মাকে দেখতে গেলেন কলেজের শিক্ষক শিববাবুর স্ত্রী। তাঁকে পেয়ে আম্মা যেন মাঝ সমুদ্রে নৌকা পাইল, অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে তাঁকে রাজি করাইল আম্মাকে করটিয়ায় ফিরায়ে নেয়ার। উনি চাইছিলেন ডাক্তারকে বলতে কিন্তু আম্মা সেইটা কিছুতেই করতে দিল না। তার ভয় ছিল ডাক্তার জানলে কিছুতেই বাড়িতে যাইতে দিবে না। তাই চুপি চুপি হাসপাতাল থেকে পালায়ে গেল শিববাবুর বউয়ের সাথে উনার গাড়িতে।

বাসায় গিয়ে তো মহা উথালপাথাল। বাইরে শুরু হইছে ঝড়বৃষ্টি। এদিকে আব্বা তখনও ঢাকায় এবং আম্মার অপকর্মের কথা তখনও জানে না। আমি যে মহা সমস্যাজনক বাচ্চা হব, সেইটা তখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াইতেছি। কলেজের প্রফেসররা সবাই বাসায় চলে আসছেন। সাদাত কলেজে ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেবের চাকরিরই ততদিন তেত্রিশ বছরের বেশি আর আব্বার বয়স ত্রিশ। উনি আড়ালে আব্বাকে ডাকতেন ‘বাচ্চা প্রিন্সিপাল’। যেকোনো কাজ আব্বা বলার আগেই করার চেষ্টা করতেন আর বলতেন, “আগেভাগেই করে রাখি, বাচ্চা প্রিন্সিপালের বকা খাইলে বেইজ্জতি হইতে হবে।” তো সেই বাচ্চা প্রিন্সিপালের বাচ্চা বউয়ের বাচ্চা! উৎকণ্ঠার সীমা নাই। সবাই আল্লাহ আল্লাহ করতেছেন যেন ভালয় ভালয় সব ঠিক হয়। ঢাকায় লোক পাঠানো হইছে আমার বড় মামাকে খবর দেয়ার জন্য। একজন ধাত্রীকে নিয়ে আসা হইল। বাইরে ঝড়ের সাথে সাথে আম্মার কষ্ট বাড়তেছে। একসময় মনে করা হইল, বাসায় ডেলিভারি সম্ভব না, হাসপাতালে নিতে হবে। সেই প্রচণ্ড ঝড় আর মূষলধারে বৃষ্টিতে অ্যাম্বুলেন্স এবং স্ট্রেচারই বা কীভাবে জোগাড় হবে?

হিরা মামা তখন আব্বা-আম্মার সাথে থেকে সাদত কলেজে পড়ত। আম্মার পিঠাপিঠি ভাই। কলেজের হার্ট থ্রব। কলেজের মেয়েরা তার প্রেমে পাগল। একটু নেক নজরে আসার জন্য আমাদের বাসায় আসা যাওয়া করে। আমাকে কোলে নেয়া হিরা মামার একটা ছবি আমাদের বাসায় ফ্রেম করা ছিল অনেকদিন। কী যে সুন্দর! সাদা-কালো ছবি, একটা স্ট্রাইপ্‌ড শার্ট। নির্ভীক খোলা চোখের দৃষ্টি। চোখে-মুখে, দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে তারুণ্য। আমার সেই মামার এখন সব চুল সাদা, দাঁত আছে মাত্র কয়েকটা, শক্ত কিছু খেতে পারে না, হার্ট বাইপাস হইছে… সময় যে কী নিষ্ঠুর!

সেই ঝড়-তুফানের রাতে আম্মা ব্যথায় কাতরাইতেছে। আমার দাদি হিরা মামার কাছে গিয়ে জানতে চাইল, তার পুরোনো ফেলে দেয়ার মতন কোনো কাপড় আছে কিনা, ডেলিভারিতে কাজে লাগবে। মামা ততক্ষণে কানতে কানতে চোখ ফুলায়ে ফেলছে… সে নাকি উত্তর দিছিল, “আমার পিন্দনের কাপড় ছাড়া আর সব নিয়া যান।” ঢাকা ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারে, আমাদের তিনতলার বাসার বারান্দায় বসে আমার জন্মের গল্প বলতে বলতে দাদি এই কথা আমাকে বলছিল।

করটিয়ার বাসার বাবুর্চি ছিলেন বারেক। উনার কতরকম কর্মকাণ্ডের কথা যে আব্বা আম্মা বলে! উনি নাকি লাউমাচা থেকে অর্ধেকটা লাউ কেটে এনে রান্না করতেন, তাতে বাকি অর্ধেকটা তাজা থাকত। আব্বা যখন কলেজে তার রুমে কাজ করত, বারেক বাসায় চা বানায়ে পিরিচ দিয়ে ঢেকে সেই কাপ উল্টায়ে নিয়ে দৌড়ায়ে যাইতেন আব্বারে চা দিতে। এক ফোঁটা চা চলকাত না, আর চা নাকি থাকত আগুন গরম। চা ঢালার আগে কাপটা যে গরম পানিতে ধুয়ে নিতে হয়, এই জিনিস আম্মা শিখছিল বারেকের কাছে।

আম্মাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য বারেক সেইদিন ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে একটা পরিবহনের খোঁজ করতেছিলেন। আর তার সাথে নাছোড়বান্দা আমার ছোট মামা, তার তখন মাত্র বারো বছর বয়স। শেষে জোগাড় হইছিল একটা ট্রাক এবং লাশের খাট। সবাই ভয় পাইতেছে হয়ত আর বাঁচবে না আম্মা। দোয়া দরুদ পড়তেছে, নামাজ পড়তেছে…।

কতবার যে শুনছি এই গল্প। এখন মনে হয়, আমি দেখছি সেইসব, আমার নিজের জন্মানো। গল্পের এই পর্যায়ে আম্মা আমার মুখের দিকে তাকায়ে বলে, “তারপরে তো তুই আসলি, দুধে আলতা গায়ের রঙ, খাড়া নাক! দেখলে বোঝাই যায় না মাত্র জন্মাইলি, বড়সড় বাচ্চা! সবাই বলতেছিল, এইজন্যই তো এত কষ্ট হইছে।” (হা হা আমার গায়ের রঙ কিন্তু আসলে শ্যামলা এবং নাকও ওইরকম তলোয়ারের মতন না!)… সবাই নাকি একটু কোলে নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেছিল, ভোরের দিকে হইছিলাম আমি।

ফরিদ মামা, আমি আর ইফা, ঢাকা ইউনিভার্সিটি।

ততক্ষণে মির্জাপুর হাসপাতাল ঘুরে আম্মাকে না পেয়ে আব্বা বাসায় চলে আসছে। ডাক্তার ভয়ে ভয়ে আব্বারে বলছে আম্মার পালায়ে আসার কথা। আমরা হাসাহাসি করতে করতে আম্মারে ট্রান্সলেশন দেই, “ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী রাজা লক্ষ্মণ সেন এর মতন খিড়কির দরজা দিয়া পলায়ন করিল—বল এইটার ইংলিশ কী হবে?’

আমি আর সানিয়া, মিরপুর।

বড় মামাও পৌঁছাইছে ঢাকা থেকে। তখন হইচই, মহা সমারোহে খাওয়া দাওয়া। ফরিদ মামা, মানে আমার ছোট মামা বলে যে যখন আব্বা, ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেব আর আমার বড় মামা একসাথে হইত তখন নাকি মজার একটা বিষয় ঘটত। বড় মামা সাদাত কলেজে পড়ছিলেন এবং ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেব তখনও কলেজের শিক্ষক, সেই সুবাদে মামার স্যার। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বড় মামা ছিল আব্বার স্যার আর করটিয়া কলেজে আব্বা যেহেতু প্রিন্সিপাল তাই ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেব আব্বারে ডাকতেন স্যার। উনারা একসাথে খাইতে বসলে স্যারের মেরি গো রাউন্ড চলত, সবাই কারো না কারো স্যার!

আমার জন্মদিনে সাধারণত চার পাঁচটা কেক জমে। আমার অফিসের কলিগদের থেকে একটা কেক, ছোট মামা মামীর থেকে আরেকটা, ছোট বোন ইফা, বোন জামাই আশিক আর আমার দুই ভাগ্নির তরফ থেকে একটা আর মেজো বোন সানিয়ার ঘরে বানানো আরেকটা। আমরা নিজেরা নিজেরাই বাসা ভর্তি হয়ে যাই। কিছুদিন আগেও কেকগুলা সব কাটত আমার ছোট ভাগ্নি রোকেয়া, সে জানত, পৃথিবীর সব কেক তার কাটার জন্যই অপেক্ষা করতেছে।

এ বছরেও আমার বন্ধুরা, অফিসের কলিগ, বাসার সবাই বিভিন্নভাবে আমারে ভাল রাখার চেষ্টা করতেছে। তবু থেকে থেকে বুকের নিচে ব্যথাটা তার অস্তিত্ব জানান দেয়। বিকাল শেষ হয়ে সন্ধ্যা আসতেছে। জানালার ওই পারে আকাশটা কমলা আর সোনালীতে ভরে যাইতেছে, আর আলোটুকুকে জড়ায়ে আছে ছাই রঙের মেঘ। বোধহয় বৃষ্টি হবে। আম্মার শরীরটা ভাল না। সারাদিন নাকি বসে থাকতে পারতেছিল না। আব্বাও একদম ঘরবন্দি থাকে, অনেক জোর করলেও বাইরে যেতে চায় না। ভয় হয়, খুব ভয় হয়। মনে মনে আল্লাহকে বলি, যেন সবাই একসাথে আরো কিছুদিন থাকতে পারি। সেই গেমস অব থ্রোনস এ ছোট্ট আরিয়াকে তার তলোয়ার শিক্ষক বলছিল, “মৃত্যু অমোঘ, সে আসবেই… তোমার শুধু বলতে হবে নট টু ডে”… নট টু ডে, আজকে না। মেঘগুলি চাদরের মতন বিছায়ে যাচ্ছে আকাশে। কমলা আলো আড়ালে চলে যাইতেছে। আমার জন্মের সময়টা কল্পনা করি, বাইরে ঝড়, ভিতরে এতগুলি আনন্দিত মানুষ একজন সদ্যোজাতকে ঘিরে। এত বছর পরে সেই মানুষগুলা কই? তেজপাতা গাছটার মাথা দুলতেছে । বাতাসে আসন্ন ঝড়ের আভাস…।

মেলবোর্ন, ২৪ অক্টোবর ২০২৪

লুনা রুশদীর আরো লেখা: মাছের জীবন

লিংক: ফেসবুকরকমারিগুডরিডস