লুসিয়াস আপুলিয়াস এর ‘মেটামরফোসিস’ অথবা ‘দ্য গোল্ডেন অ্যাস’
গোল্ডেন অ্যাস দ্বারা প্রভাবিতদের মাঝে সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ নিশ্চয়ই উইলিয়াম শেকসপিয়ার।
গোল্ডেন অ্যাস দ্বারা প্রভাবিতদের মাঝে সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ নিশ্চয়ই উইলিয়াম শেকসপিয়ার।
১৮০ সালের দিকে লুসিয়াস আপুলিয়াস নামের একজন লেখক লাতিন ভাষায় একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। পান্ডুলিপিতে ওই সাহিত্যকর্মের নাম দেয়া ছিল ‘মেটামরফোসিস’; কিন্তু তার সে বইকে এখন পৃথিবী সবচেয়ে বেশি চেনে ‘দ্য গোল্ডেন অ্যাস’ নামে।
বইটা নিয়ে ইতিহাস ও সাহিত্য বিশারদদের প্রচুর বোঝাপড়া আছে, কিন্তু ‘গোল্ডেন অ্যাস’ বোধহয় একারণেই সবচেয়ে বিখ্যাত যে লাতিন ভাষায় লেখা এটাই একমাত্র রোমান ‘উপন্যাস’ যা অক্ষত অবস্থায় আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে।
হ্যাঁ, জঁনরার বাছবিচারে চাইলে একে নানারকম তকমা দেওয়া যায়, কিন্তু একদম মোটাদাগে দেখলে ‘গোল্ডেন অ্যাস’ আগাগোড়া একটা উপন্যাস; অথবা জিজ্ঞাসু পাঠকরা একে ‘পিকারেস্ক’ উপন্যাসের একেবারে প্রথম দিককার নমুনা হিসাবে ধরে নিতে পারেন।
পিকারেস্ক গল্পের নায়করা হয় সামাজিক শ্রেণির বিচারে নিচু বর্গের, নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারে শিথিল আর গল্প বলার ধরনে স্যাটায়ার ও কমেডি থাকে প্রচুর।
আয়মান আসিব স্বাধীন
প্লট সহজে ধরাছোঁয়া যায় না, কারণ একের পর এক ছোট-বড় পর্ব দিয়েই কাহিনি আগাতে থাকে৷ পর্বগুলি আসলে নায়কের একেকটা অভিযান, যেখানে নিজের বুদ্ধি দিয়ে সারভাইভ করতে হয় তাকে।
‘গোল্ডেন অ্যাস’ শুরু হয় এরকম এক নায়কের প্রথম পুরুষের জবানিতে। ওর নাম লুসিয়াস। ব্যবসাপাতির কাজে গ্রিসের এক এলাকায় যাচ্ছিল, পথিমধ্যে সহযাত্রীদের কাছ থেকে জাদুটোনা নিয়ে কয়েকটা ভীতিকর গল্প ও হুঁশিয়ারি শুনতে পায় সে। কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ হয় না, ঘটনাচক্রে ভুল মন্ত্রবলে মানুষের থেকে গাধায় রূপান্তরিত হয়ে যায় তার শরীর। তারপর থেকে গাধার দেহে মানুষের বোধ-জ্ঞান নিয়ে সে তার আশেপাশের মানুষদের কাণ্ড দেখতে থাকে। পালা করে এক লোক থেকে আরেক লোকের দ্বারে গিয়ে পৌঁছায়, ঘুরতে থাকে, আর বোঝার চেষ্টা করে তাদের লোভ, ধোঁকাবাজি, লালসা, হিংসা ও ক্ষমতার বিষম মিশ্রণের দৈনন্দিন জগতটাকে।
এই যে দেহের গড়ন রূপান্তরিত হয়ে মানুষ থেকে গাধা হয়ে যাওয়া—একারণেই বইয়ের নাম ‘মেটামরফোসিস’ বা রূপান্তর। তবে শুধু এই এক প্রকারের রূপান্তর না (বইয়ের শিরোনাম Metamorphoses-ও তো Metamorphosis এর বহুবচন); এখানে লুসিয়াসের দেহের গড়নের সাথে ভাগ্যেরও রূপান্তর ঘটে।
আপুলিয়াস যখন বইটা লেখেন, তখন রোমান কবি ওভিডের একই নামের বিখ্যাত এক আখ্যানকাব্যের সাথে তার ভালোমতো পরিচয় ছিল। তিনি যে বইয়ের নামটাই শুধু এক রেখেছেন তা না, ওভিডের কাব্যের মতো তার বইয়েরও কোনো ঘটনা বা ক্যারেক্টারের প্রকৃতি স্থির থাকার নিশ্চয়তা নাই; কোন চরিত্র শুরুতে যেমন থাকে, পরেও যে তেমন থাকবে তা সহজে ধরে নেওয়া যায় না।
খ্রীষ্টধর্মের সন্ত ও দার্শনিক অগাস্টিন (সেইন্ট অগাস্টিন) পঞ্চম শতাব্দীতে তার বই ‘সিটি অফ গড’-এ আপুলিয়াসের ‘মেটামরফোসিস’কে প্রথম ‘গোল্ডেন অ্যাস’ বা সোনালি গাধা বলে উল্লেখ করেন। যেহেতু ওভিডের কাব্যগ্রন্থের সাথে নাম গুলায়ে ফেলারও আর কোনো আশঙ্কা তাতে থাকে না, তাই এ নামটাই ছড়িয়ে পড়ে জনমুখে।
আপুলিয়াসের জন্ম ১২০ এর দশকের মাঝামাঝি, উত্তর আফ্রিকার রোমান উপনিবেশ মাদাউরস শহরে (যা এখন আলজেরিয়ায়)। তার বাবা ছিলেন ওই উপনিবেশের দুইজন প্রধান বিচারকের (Duumvir) একজন, তাই কম বয়স থেকেই পড়ালেখার ব্যাপারে অনেক এগিয়ে ছিলেন আপুলিয়াস।
প্রথমে কার্থেজ শহর (বর্তমান তিউনিসিয়ায়) ও পরে অ্যাথেন্সে উচ্চশিক্ষা নেন তিনি। কার্থেজে থাকার সময় থেকেই দর্শনশাস্ত্রের শিক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন আপুলিয়াস। প্লেটো ও সক্রেটিসের দার্শনিক অনুসন্ধান নিয়ে আলাদা আলাদা বই আছে তার। বেঁচে থাকতে লেখকের পাশাপাশি তার প্রধান পরিচয় ছিল একজন অলঙ্কার শাস্ত্রবিদ (রেটোরিশিয়ান) ও সেই ধারায় একজন সুবক্তা হিসাবে। মাদাউরসে তার স্মৃতিরক্ষায় সে সময়েই বানানো হয় ভাস্কর্য, যার নিচে খোদাই করা ছিল “সেই প্লেটোনিক দার্শনিকের উদ্দেশে”। এছাড়া তার সম্মানে মূর্তি ছিল কার্থেজেও।
তবে জীবদ্দশার খ্যাতি এবং অনুরাগীদের দলও তার ‘গোল্ডেন অ্যাস’ এর মূল্যায়ন ত্বরান্বিত করতে পারে নাই। ছয় থেকে তেরো শতক পর্যন্ত বলা যায় উপন্যাসটার সাহিত্যিক দাম যাচাই করা একরকম বন্ধই ছিল। মানুষজন আপুলিয়াসকে এই লম্বা সময় ধরে মনে রাখে আসলে একজন জাদুকর হিসাবে। ‘গোল্ডেন অ্যাস’ এ বর্ণিত সব জাদুটোনার কারবার সত্যি কিনা তা নিয়ে নিজ বইয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন সেন্ট অগাস্টিন (তার মানে তখনকার সময়ে ধর্মের পাশাপাশি এরকম অলৌকিকতায় বিশ্বাস করা এতই সাধারণ ঘটনা যে তার সত্যতা নিয়ে আলাদা করে আপত্তি জানানোরও অবকাশ ছিল)। সেই সাথে আপুলিয়াস যখন এক ধনী বিধবাকে বিয়ে করেছিলেন, ওই বিধবার আত্মীয়-স্বজন সম্পত্তি বেদখল হবার ভয়ে মামলা ঠুঁকে দেয় তার নামে। সেখানে অন্যান্য অভিযোগের পাশাপাশি এটাও ছিল যে, জাদুবিদ্যার সাহায্যে ওই বিধবাকে মোহমুগ্ধ করে বিয়ে করেছেন আপুলিয়াস। ১৬০ সালের দিকে নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন ও বাগ্মিতার বদৌলতে মামলা থেকে খালাস পান উনি, যার লিখিত রূপ ‘অ্যাপলজিয়া’ নামের বইয়ে সংরক্ষিত আছে।
ফলে কথাসাহিত্যিকের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য রেনেসাঁস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় আপুলিয়াসকে। ১৫০০ সালের পর খুবই কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ‘দ্য গোল্ডেন অ্যাস’ জর্মন, ফরাসি, স্প্যানিশ ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। এরও অনেক আগেই ইতালীয় সাহিত্যিক পেত্রার্ক এবং জোভান্নি বোকাচ্চো’র কাছে এ বইয়ের নিজ হাতে লেখা কপি ছিল। বোকাচ্চো নিজের উপন্যাস ‘দেকামেরন’ এর জন্য তিনটা গল্প এখান থেকেই নিয়েছিলেন।
স্পেনে পিকারেস্ক উপন্যাসের প্রতিষ্ঠা ও ব্যাপ্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এ বই। মিগেল দে সেরভান্তেস তার ক্লাসিক ‘ডন কিহোতে’ উপন্যাসে সরাসরি আপুলিয়াসের গদ্যের স্মৃতি জাগাতে চেয়েছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও গোল্ডেন অ্যাস থেকে কয়েকটা দৃশ্য তিনিও ধার নিয়েছিলেন তার উপন্যাসের জন্য।
সেসময় আপুলিয়াসের বইটা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন উইলিয়াম অ্যাডলিংটন (১৫৬৬), সতেরো শতক শুরু হবার আগেই ওই অনুবাদের পাঁচটা মুদ্রণ বের হয়ে যায়। নাট্যকাররা ছাড়াও সে যুগের বিশিষ্ট ইংরেজি লেখকদের প্রায় সবাই তাদের নানা সাহিত্যিক রচনায় গোল্ডেন অ্যাস’কে কাজে লাগানো শুরু করেন। ফিলিপ সিডনি, এডমান্ড স্পেন্সার, ক্রিস্টোফার মারলো, জন মিল্টন প্রমুখ তাদের কাব্য, গদ্য ও কাব্যনাট্যে রেখে গেছেন গোল্ডেন অ্যাসে’র সচেতন প্রভাব।
তবে গোল্ডেন অ্যাস দ্বারা প্রভাবিতদের মাঝে সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ নিশ্চয়ই উইলিয়াম শেকসপিয়ার। তিনি বইটা পড়েছিলেন অ্যাডলিংটনের অনুবাদে। একটি অনুসন্ধান মোতাবেক তার মোট আটটা নাটক ও একটা কবিতায় গোল্ডেন অ্যাস খুঁজে পাওয়া যায়। আবার কেউ বলেন তার প্রায় ত্রিশটারও বেশি সাহিত্যকর্মে এর নিশানা আছে। গোল্ডেন অ্যাসে’র গল্প ব্যবহার করার একদম স্পষ্ট নমুনা পাওয়া যাবে শেকসপিয়ারের “আ মিডসামার নাইট’স ড্রিম” নাটকে, যেখানে বটম নামের এক চরিত্রের মাথা পাল্টে গাধার মুণ্ডুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাছাড়া ‘মাচ আডু অ্যাবাউট নাথিং’, ‘ওথেলো’ আর ‘হ্যামলেট’— এ নাটকগুলিতে গোল্ডেন অ্যাসে’র প্রয়োগ রীতিমতো নিঃসন্দেহ।
কিন্তু ‘দ্য গোল্ডেন অ্যাস’ এর যে একখানি গল্প তার অসংখ্য পরিবেশনার পরও এখনো সবলে টিকে আছে তার নাম ‘কিউপিড ও সাইকি’। পশ্চিমা বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট অথবা সুন্দরী ও দানব জাতীয় যত ধরনের প্রেমের রূপকথা ও এর প্রচলিত যত তরজমা আছে, তার আদিরূপ একেই ধরা যেতে পারে।
পিকারেস্ক উপন্যাসের কাঠামো অনুযায়ী গোল্ডেন অ্যাস সাজানো হয়েছে নায়ক লুসিয়াসের মানুষ থেকে গাধা হয়ে যাওয়ার আগে ও পরের নানা অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে। ফলে এখানে আছে অনেকগুলি পর্ব। গোল্ডেন অ্যাসের প্রত্যেক পর্ব স্বাধীনভাবে কাজ করলেও বইয়ের কেন্দ্রীয় বৃত্তান্তে প্রায় সবগুলি গল্পেরই ভূমিকা আছে। এরা একপাশে নায়কের চরিত্রায়ণকে জোরদার করে, আরেকপাশে তার কাহিনি এগিয়ে নেয়। আর লেখক যে কিউপিড ও সাইকি’র গল্পকে তার বইয়ে বিশেষ জায়গা দেয়ার কথা ভেবে রেখেছিলেন, তা গল্পটার অবস্থান ও বয়ান ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়। এ গল্প বলা হয়েছে বইয়ের একদম মাঝবরাবর এসে। সাহিত্যিক বিন্যাস ও দৈর্ঘ্যের দিক থেকেও অন্যান্য পর্ব থেকে এটার প্রতি তার অ্যাপ্রোচ আলাদা৷
কিউপিড ও সাইকির নিজেদের যে অ্যাডভেঞ্চার, তা আসলে গল্পের ভেতরের গল্প। উপন্যাসের মূল চরিত্র লুসিয়াস আরেকজনের মুখ থেকে এ গল্প শোনে। আর বইয়ের ‘কেন্দ্রীয়’ পর্ব হিসাবে এটি সিলেক্ট করার পেছনের সাহিত্যিক কৌশলটা তখনই বোঝা যায়, যখন আপনি কাহিনিটাকে রূপক বা অ্যালেগরি হিসাবে দেখতে পারেন। কিউপিড আর সাইকি’র আখ্যান আসলে লুসিয়াসের আখ্যান। আর সাইকি’র পরিণতি থেকেই লুসিয়াসের শেষ গন্তব্য আন্দাজ করে নিতে পারি আমরা। এটাই গল্পের-ভেতরকার-গল্প, তলের ওপর অতল, স্টোরি উইদিন আ স্টোরি (কোনো লেখার প্রধান গল্প যে রকম, ওই একই ছাঁচে অন্য এক সহায়ক গল্প বানিয়ে তা এভাবে লেখার ভেতর ‘ঢুকিয়ে’ দেওয়ার আয়োজনকে বলে মিজ অঁনাবিম/Mise en abyme)।
আপুলিয়াস যে পুরাপুরি নিজে থেকেই কিউপিড-সাইকির প্রেমকাহিনি বানিয়েছেন তাও না। নিজের প্লেটোনিক শিক্ষার পাশাপাশি জন্মভূমির এক লোকগাথাকেও সম্ভবত এতে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। প্লেটোর ‘ফিদ্রাস’ ও ‘সিম্পোজিয়াম’ পুস্তকে বর্ণিত মিথে এর পূর্বসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। তাছাড়া হেলেনিস্টিক যুগ থেকেই শিল্প সাহিত্যে এই থিমকে আলাদা সম্মান দেওয়া হয়েছে৷ ‘দ্য গোল্ডেন অ্যাস’ বরং রেনেসাঁস-পরবর্তী ইউরোপের প্রসিদ্ধ সব চিত্রকর্মে কিউপিড ও সাইকির প্রভাব হরেদরে ছড়িয়ে দেয়। রাফায়েলের ফ্রেস্কো’তে সম্ভবত এই গল্পের ছায়া প্রথম দেখা যায়।
বোকাচ্চো যে তার উপন্যাসের জন্য এ বই থেকে তিনটি গল্প নিয়েছিলেন তা আমরা আগেই জেনেছি, কিন্তু এর বাইরেও কিউপিড-সাইকির অধ্যায়টা তুলে নিয়ে তার নিজের মতো তরজমা করে আরেক বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন উনি, যেটা ছিল প্রাচীন গ্রিক ও রোমান দেবদেবীদের বংশবৃত্তান্তের সংকলন। আর এভাবেই বিবিধ আর্ট ফর্মে আপুলিয়াসের সোনালি গাধা থেকে কাঠামোগত, বিষয়ভিত্তিক ও থিম্যাটিক অনুপ্রেরণা নেওয়া চলতে থাকে, যা এসময়ে এসেও থেমে যায় নাই। ফিল্মমেকার রবের ব্রেঁসোর ১৯৬৬ সালের মুভি ‘ও আজার বালতাজার’ সেই লিগ্যাসি বহাল থাকার দিকেই নির্দেশ করে। এ সিনেমার নায়ক বালতাজার নামের এক গাধা, যে তার মালিকদের সব ধরনের কাজকারবার প্রত্যক্ষ করে হাতবদল হতে হতে শেষ পর্যন্ত তার মালিকদের হাতেই অপদস্থ হয়। তবে ব্রেসোঁ’র গাধাকে অবশ্যই মানুষ থেকে জাদুটোনার মধ্য দিয়ে গাধা হতে হয়নি, সে আসলেই এক অবলা প্রাণী, আর তার রূপান্তরও অনেক বেশি ক্যাথলিক বিশ্বাসের চাদরে মোড়া।
এতজন শিল্পীর এত এত আর্টস্টিক প্রকাশনে ছাপ রেখে যাওয়া এই লাতিন ক্লাসিক বইটা আপুলিয়াস নিজেও এক গ্রিক আখ্যানের ছায়া অবলম্বনে লিখেছিলেন। আপুলিয়াসের সমসাময়িক গ্রিসের প্রখ্যাত স্যাটায়ার লেখক লুসিয়ানের লেখালেখির মধ্যে ‘লুসিয়াস অর দ্য অ্যাস’ নামে বই আছে একটা। হয়ত লুসিয়ান ও আপুলিয়াস দু’জনই কমন আরেকটা উৎস থেকে তাদের বইয়ের রূপরেখা ধার করেছিলেন৷ কিন্তু লুসিয়ানের বইটা গোল্ডেন অ্যাসে’র চাইতে অনেক ছোট। মূল বইটাও খুব বেশি বড় ছিল না বলে ধারণা করা হয়। বলা যায়, আপুলিয়াস সাদামাটা একটা গল্পসংগ্রহকে রঞ্জিত করে উপন্যাসের উপযোগী চরিত্রায়ণ ও ডিটেইল এনেছেন, আর সকল দরকারি ড্রামাটিক সম্ভাবনা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে দেখার জন্য যোগ করেছেন বাড়তি অনেক ঘটনা যা মূল লেখায় ছিল না—আর এসবের জোট যাতে নড়বড়ে না হয় তা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করেছেন রেটোরিশিয়ান হিসাবে নিজের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে৷
আপুলিয়াসের অনেক শব্দচয়ন তৎকালীন লাতিন বিশ্বের জন্যও ছিল প্রাচীন ও অপ্রচলিত। প্রয়োজনে তিনি নিজের মতো করে শব্দরীতি পাল্টে এবং কিছু নতুন শব্দ তৈরিও করে নিয়েছেন। আর কখনো কখনো ছন্দের অতি সচেতন ব্যবহারে তার শব্দবন্ধের সমাহার এতটাই প্রচণ্ডভাবে লাতিন ভাষার নিজস্ব মেজাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে, যেকোনো ভাষায় অনুবাদের ক্ষেত্রেই সেই গদ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা কঠিন হয়ে যায়। তবে আধুনিক ইংরেজি ভাষায় তার লেখার একটি দিক অন্তত প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন লাতিন ভাষাবিশারদ ই.জে. কেনি; আর তা হলো সাবলীলতা।
এ বইয়ের প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছিলেন মনে হয় আবদুল গনি হাজারী (১৯৬৪)। কিন্তু তার ভাষ্যমতে, সেই অনুবাদে বাঙালি পাঠকদের সংবেদনশীলতায় আঘাত না করার জন্য বইটার কিছু বর্ণনার ধরন এড়িয়ে গেছিলেন তিনি। তাছাড়া আধুনিক ইংরেজিতে লেখা হওয়ায় তখন মূলত কবি রবার্ট গ্রেভসের অনুবাদটাই অনুবাদকের প্রধান অবলম্বন ছিল। সেই সময়কার বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদেরকে আর পরবর্তী সব অনুবাদককে দিশা দেখানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ।
‘দ্য গোল্ডেন অ্যাস’ এর যেকোনো পাঠপ্রতিক্রিয়া আপনাকে বলবে কীভাবে এই উপন্যাস বার বার করে পড়ার মাধ্যমে নতুন নতুন জিনিস খোলাসা হয়, যা একবারের টানা পড়ে যাওয়ার মধ্যে আপনি কখনো পাবেন না। আপুলিয়াস নিজেও তা জানতেন, আর তাই প্রথম পাতাতেই তার গল্পকথক সরাসরি পাঠকদের সম্বোধন করে তাদের “মনোযোগ” চেয়ে নেয়। কারণ, যদি আপনি যথেষ্ট “মনোযোগ” দেন, কেবল তাহলেই গল্পটা “উপভোগ্য” হবে আপনার কাছে।
অবশ্য যে উপন্যাসের ভকাবুলারিতে সুনির্বাচিত ও কথ্য শব্দের অহরহ মিশ্রণ থাকে, এবং কাহিনির ঘনঘটাতে থাকে নীতিগল্পের সাথে স্যাটায়ার, হিউমারের পাশাপাশি ভায়োলেন্স, অ্যালেগরি ও জবানবন্দির গাম্ভীর্যকে হালকা করার জন্য সেক্স, ভাঁড়ামি ও গ্রাঁ গিঁনলের স্বচ্ছন্দ স্থাপনা—তার কাছ থেকে এর চাইতে কম কিছুও বা আশা করবেন কেন?
এক কাহিনির সাথে আরেক খানা জোড়া দিতে থাকা, আর বিবিধ মাত্রার সেইসব কাহিনির বুনন যাতে কোনোভাবেই বইয়ের মূল বয়ানের ছন্দে দৃষ্টিকটু ওঠানামা না করায় সেদিকে খেয়াল রাখা—যে গল্পকার এই দুই দিক সামাল দিয়েও দিশাহারা না হয়ে পাঠকের মনোযোগ নিজের মতো ম্যানিপুলেট করতে পারেন, তাকে সফল ঔপন্যাসিক অন্তত বলা যায়; আর একই সূত্রে তার সাহিত্যকর্মকে ক্লাসিক।
(গোল্ডেন অ্যাস উপন্যাসের শুরু)