প্রাচীন গ্রিসের শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল প্লেটোর একাডেমি। এটি পশ্চিমা দুনিয়ার প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেটা অ্যারিস্টটলের স্কুল তৈরির পেছনেও অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছে। অ্যারিস্টটলের স্কুল প্লেটোর একাডেমির মতই বৈজ্ঞানিক গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। যদিও প্লেটোর একাডেমি আধুনিক কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে কম আনুষ্ঠানিক ছিল, তবে বর্তমানে বিপুল সংখ্যক স্কুল যে নামের সাথে “একাডেমি” শব্দ ব্যবহার করে, তা প্লেটোর স্কুলের স্থায়ী প্রভাবকেই নির্দেশ করে। প্লেটোর একাডেমি একটানা ৩০০ বছর স্থায়ী হয়।

প্লেটো (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৭-৩৪৭) কেন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এথেন্সে এর অবস্থান (যা আজকের দিনেও কেউ দেখে আসতে পারেন), এবং প্রাচীন উৎস থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে প্লেটোর একাডেমিতে কী কী ঘটত, তা নিয়ে এই লেখা।

প্লেটোর একাডেমি
১৫০৯ থেকে ১৫১১ সালের মধ্যে আঁকা রাফায়েল এর বিখ্যাত ফ্রেস্কো ‘দ্য স্কুল অফ এথেন্স’ এর একটি দৃশ্যে প্লেটো ও তার ছাত্র অ্যারিস্টটল।

প্লেটো কেন একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন

প্লেটোর বয়স যখন ২০ বছর, তখন তিনি দার্শনিক সক্রেটিসের সাথে দেখা করেন। তরুণ প্লেটো সমাজের উন্নতিতে অবদান রাখতে চেয়েছিলেন, তাই রাজনীতিতে যোগ দেবেন বলে মনস্থির করেন। কিন্তু, তৎকালীন এথেন্সের অন্যায় ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলি দেখে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। প্লেটোর ২৮ বছর বয়সে, তার গুরু ও প্রিয় বন্ধু সক্রেটিসকে মিথ্যা অভিযোগে ধর্মবিরোধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

এর কিছুকাল আগে, এথেন্সে ৮ মাস ক্ষমতায় থাকে ‘ত্রিশজন স্বৈরাচার’। প্রথমে প্লেটো ত্রিশজন স্বৈরাচারদের নিয়ে আশাবাদী ছিলেন, পরে তাদের বিষয়ে প্লেটোর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। তারা যখন সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, তখনই তিক্ত সত্য বের হয়ে এলো। ত্রিশজন স্বৈরাচার তাদের সেই অল্প সময়ের শাসনামলে কোনো বিচার ছাড়াই ১,৫০০ এথেনীয়কে মৃত্যুদণ্ড দেয়, নাগরিকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে এবং অগণিত লোকদের নির্বাসনে পাঠায়।


ডেভিড ফিডেলার
অনুবাদ: জুবায়েদ দ্বীপ


এসব ঘটনার ওপর ভিত্তি করে প্লেটো সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে গ্রিসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখনই উন্নত হতে পারে যদি এর রাজনীতিবিদরা গুডনেস বা ভালত্ব ও ন্যায়ের প্রকৃতি ভালভাবে বুঝতে পারেন। সক্রেটিসও আগে এই প্রশ্নগুলি খতিয়ে দেখেছিলেন। এবং এগুলি প্লেটোর চিন্তারও কেন্দ্রে ছিল।

প্লেটো সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, রাজনৈতিক সমস্যা শেষ হবে না যতক্ষণ না দার্শনিকরা রাজা হন অথবা রাজারা দার্শনিক হন। সংক্ষেপে, এটি ছিল প্লেটোর বিখ্যাত “দার্শনিক রাজা” ধারণাটির মূল বিষয়। তার মতে, কেবলমাত্র যথার্থ শিক্ষিত শাসক, যিনি ভালত্ব ও ন্যায়ের প্রকৃতি ভালভাবে বুঝতে পারেন, সেই সঠিক দৃষ্টিকোণ লাভ করবেন যার দ্বারা সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

প্লেটো দক্ষিণ ইতালির আরেক দার্শনিক ধারা পিথাগোরীয়দের সাথেও যোগাযোগ রাখতেন। তার বন্ধু টারেন্টামের আর্কিটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৩৬০-৩৫০ সাল) এই ধারার অনুসারী ছিলেন। আর্কিটাস একজন পিথাগোরীয় দার্শনিক, গণিতবিদ, উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে ইতিহাসে পরিচিত। তিনি ছিলেন টারেন্টাম শহরের জনপ্রিয় নেতা। সেখানকার আইন অনুসারে একবারের জন্য নির্বাচিত হওয়ার নিয়ম থাকলেও তিনি পর পর ৭ বছর শহরের নেতা নির্বাচিত হন।

প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ নামের সংলাপে যে ‘দার্শনিক রাজা’ বা রাজনৈতিক অভিভাবকের ধারণা দিয়েছিলেন, সম্ভবত আর্কিটাসই ছিলেন তার আদর্শ। দক্ষিণ ইতালির আরেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ডিওনিসিয়াস-১। তাকে প্লেটো বিশেষ পছন্দ করতেন না। সম্ভবত প্লেটোর একই সংলাপে আমরা যে অত্যাচারী শাসকের দেখা পাই, ডিওনিসিয়াস-১ ছিলেন তার আদর্শ।

প্লেটো একাধিকবার দক্ষিণ ইতালিতে গেছেন। প্রথম যাত্রায় তিনি আর্কিটাস ও অন্যান্য পিথাগোরীয় দার্শনিকদের সাথে দেখা করেন এবং তিনি পিথাগোরীয়দের পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। এই সাক্ষাৎগুলি নিশ্চিতভাবে প্লেটোকে তার দার্শনিক স্কুল, একাডেমি, প্রতিষ্ঠা করতে অনুপ্রাণিত করে। কারণ এথেন্সে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি একাডেমি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন।

প্লেটোর একাডেমি প্রতিষ্ঠার আগে, এথেন্সের স্কুলগুলি ছিল শিশু বা কিশোরদের জন্য। সেখানে শিক্ষার্থীরা কিছু প্রাথমিক বিষয় যেমন, শরীরচর্চা, পড়া ও লেখা, সাহিত্য, গণিত ও গীতিকবিদের রচনাগুলি শিখত। এরপর, শিক্ষার্থীরা নাগরিক জীবনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাদবাকি শিক্ষা লাভ করবে এমনটাই আশা করা হত।

প্লেটোর একাডেমির প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান

এই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির বাইরে তৎকালীন এথেন্সে শিক্ষা দেবার জন্য ছিলেন সফিস্টরা (কূটতার্কিক)। তারা অর্থের বিনিময়ে জনসাধারণদের, অন্যদের সহজে প্রভাবিত করার মত চতুরভাবে কথা বলার শিল্প শেখাতেন। এথেন্সের মত শহরে, পেশাগত উন্নতির জন্য অন্যদের সহজে প্রভাবিত করার মত সুকৌশলী পন্থায় কথা বলতে পারা একটি জরুরী দক্ষতা ছিল। দুঃখজনকভাবে, সফিস্টরা ছিলেন আদালতের সেইসব মার্জিত আইনজীবীদের মত, যারা অন্তর্নিহিত সত্যকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি মামলার যেকোনো পক্ষের বিপক্ষে বা পক্ষে যুক্তি দিতেন। সন্দেহ থাকলেও, সম্ভবত সফিস্ট প্রোটাগোরাস বলেছিলেন, “মানুষই হল সবকিছুর মাপকাঠি।” আরেকজন সফিস্ট থ্রাসিমাচাস দাবি করেছিলেন, “শক্তিশালীর শাসনই ন্যায়।”

তাদের এই প্রশ্নসাপেক্ষ বা নৈতিকভাবে অসমর্থনীয় ধারণাগুলির কারণে—এবং যা প্রায়শই পুরোপুরি নৈতিক আপেক্ষিকবাদ বা মোরাল রিলেটিভিজমেরই একটি রূপ—সফিস্টরা প্রায়শই সক্রেটিসের চুলচেরা বিশ্লেষণের মুখে পড়তেন। সক্রেটিস তাদের সাথে সংলাপে জড়িত হতেন। তাদের আইডিয়া, শিক্ষা ও উপদেশগুলি পরীক্ষা করতেন। সফিস্টদের সাথে আলাপের সময়ে সক্রেটিস তার বিখ্যাত ডায়ালেকটিক বা দ্বান্দ্বিক বিচার পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এ পদ্ধতিতে সুশৃঙ্খল প্রশ্নোত্তরের সাথে সাথে সাবধানে বিভিন্ন টার্ম বা পরিভাষাগুলির সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হত এবং যৌক্তিক অসঙ্গতিগুলি সতর্কভাবে পরীক্ষা করা হত। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে, সক্রেটিস ক্রমে সফিস্টদের মাথা ঘুরিয়ে দিতেন ও হতবুদ্ধি করে ফেলতেন। সংলাপের শেষে তারা বুঝতে পারতেন যে প্রকৃত বিশ্বাসগুলি আসলে অসাড় বা পূর্বাপর সম্পর্কহীন ও পরস্পরবিরোধী।

এই পটভূমিতে প্লেটো তার একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। পার্ক বা গ্রোভ একাডেমাসে ছিল এর অবস্থান। সেখান থেকেই এই স্কুলটির নাম হয় একাডেমি। উল্লেখযোগ্য এক বিশেষ বিশ্বাস থেকে প্লেটো এই বিদ্যালয় শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দর্শন মানুষের মনকে ভালত্ব ও সদগুণের দিকে পরিচালিত করতে পারে। এবং সমাজের সকল ক্ষেত্রই এতে উপকার পাবে।

 

প্লেটোর একাডেমির অবস্থান: পার্ক ও কুঞ্জবন একাডেমাস

এথেন্সের পাবলিক পার্কগুলিতে, বিশেষ করে যেগুলিতে শরীরচর্চা কেন্দ্র থাকত, সেসব পার্কে আলোচনা করার জন্য দার্শনিকরা মিলিত হতেন। একইভাবে, সফিস্টরা এই ধরনের পাবলিক স্থানগুলিকে বক্তৃতা দেওয়া, বাকচাতুর্য দেখানো এবং শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য ব্যবহার করত।

এথেন্সের উত্তর গেট থেকে সামান্য হাঁটা দূরত্বেই ছিল পার্ক একাডেমাস। পার্কটি এর সুন্দর অবস্থান, পরিবেশ, বিস্তৃত শাখা-প্রশাখা ও প্রশস্ত পাতার লম্বা লম্বা গাছ এবং ছায়ানিবিড় হাঁটার পথের জন্য জনপ্রিয় ছিল। বন্ধুদের সাথে আড্ডার ও অর্থবহ আলাপচারিতার জন্য এটি ছিল যথার্থ স্থান।

ঐতিহাসিক বিস্ময় হিসাবেই প্রাচীন সেই পার্কটি এখনও তার মূল অবস্থানে টিকে আছে। বর্তমানে আকাদেমিয়া প্লাটোনোস (প্লেটোর একাডেমি) নামে পরিচিত একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। ২,৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পার্কটি পুনর্নির্মাণ বা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

সত্যি-সত্যিই বর্তমান সময়ে পার্কটির লম্বা সব গাছ ও ছায়াময় পথ আগত দর্শকদের প্লেটোর সময়ের পার্কটিতে হাঁটার মতই প্রায় নিখুঁত অভিজ্ঞতা দেয়। এটি নিয়ে বিখ্যাত রোমান লেখক সিসেরো বলেছিলেন, “এই পথ এদের খ্যাতির পুরোপুরি যোগ্য।”

প্লেটোর বেড়ে ওঠা পার্ক একাডেমাসের নিকটেই। পার্কে একটি ‘পবিত্র বাগান’ ছিল। প্রাচীন বিবৃতি অনুসারে, পার্কের ছোট জলপাই বাগানটি অ্যাক্রোপলিসের শীর্ষে অবস্থিত দেবী এথেনার পবিত্র জলপাই গাছ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। পবিত্র বাগানের পাশাপাশি এখানে এথেনা, প্রমিথিউস, হেফেস্টাস, ইরোস, মিউজ এবং হেরাক্লেসের জন্য উৎসর্গীকৃত বেদীও ছিল। এছাড়াও, পার্কটিতে ছিল একটি শরীরচর্চা কেন্দ্র, যার ভিত্তিটি আজও দেখা যায়।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৭ সালে, দক্ষিণ ইতালিতে প্রথম সফর শেষে এথেন্সে ফিরে আসার পর, ৪১ বছর বয়সে প্লেটো একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের হাতে আসা পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছে এমন কিছু বিবরণ অনুসারে, প্লেটো প্রথমে একাডেমাস পার্ক থেকে একটি কেপোস (ফুল বা ফলের বাগান) কেনেন। বাগানটির মধ্যে একটি বাড়িও ছিল। বাড়িটিকে কেন্দ্র করে এখানে ব্যক্তিগত কাজের সুযোগ তৈরি হয়। তৎকালীন এথেন্সে প্রচলিত আলোচনাসভাগুলির মত এখানে মদ্যপান করতে করতে দার্শনিক আলোচনা চলত।

প্লেটোর দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছিল, একাডেমি পার্কে শিক্ষা ও জ্ঞানের দেবী ‘নয়জন মিউজ’দের উদ্দেশ্যে একটি মন্দির স্থাপন করা। সম্ভবত এই মন্দিরে নয়জন মিউজের মূর্তিও ছিল। এবং প্লেটোর মালিকানায় একটি ছোট্ট ‘মাউসিয়ন’ বা ‘মিউজদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত একধরনের স্থান’ থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে।

মিউজদের এই ধরনের মন্দিরগুলি তখনকার গ্রিক স্কুলগুলিতে, এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। ‘মাউসিয়ন’ থেকেই আধুনিক ‘মিউজিয়াম’ শব্দটি এসেছে, যা দিয়ে শিক্ষার জন্য উৎসর্গীকৃত স্থানকে বোঝায়।

পরবর্তী সময়ের রোমানদের মানদণ্ডের তুলনায় প্লেটোর বাগান ও বাড়িটি ছোট হলেও, দর্শনের পণ্ডিত জন ডিলন মনে করেন বাগানটির আয়তন কয়েক একর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকতে পারে। প্লেটোর বাড়িতে নিশ্চিত কয়েকটি কক্ষ ছিল। একটি ঘর ছিল শুধু আলাপচারিতার জন্য। গ্রিক ভাষায় এর নাম ‘এক্সেড্রা’। স্কুলের বই ও পাণ্ডুলিপিগুলি রাখার জন্য এখানে একটি গ্রন্থাগারও ছিল।

প্লেটোর একাডেমির গঠন ও বিন্যাসের কৌশলটি ছিল চমৎকার। বিদ্যালয়টি ছিল একইসাথে সর্বজনীন ও ব্যক্তিগত। একাডেমি পার্কেই বিদ্যালয়ের অনেক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হত। প্লেটোর একাডেমির সদস্যরা একত্রে মিলিত হয়ে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আলাপ করতেন। অন্যান্য বিভিন্ন কার্যক্রম প্লেটোর বাগানে ও বাড়িতে হত। যেন দুটি ভিন্ন জগতের সেরা অনুভূতি লাভ করার মত; একদিকে বিদ্যালয়ের নিজস্ব ব্যক্তিগত স্থান, এবং এর সাথে সবার জন্য উন্মুক্ত ক্যাম্পাসে বিনামূল্যে প্রবেশাধিকার। তবে, প্লেটোর বিদ্যালয়ের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যই বর্তমানে আমাদের জন্য বিভ্রান্তিও তৈরি করে, কারণ প্রাচীন লেখকরা যখন প্লেটোর “একাডেমি”কে বিদ্যালয় গণ্য করে কিছু বলেন, তখন তারা একাডেমি বলতে পার্কটিকে বোঝাচ্ছেন নাকি প্লেটোর ব্যক্তিগত সম্পত্তির অংশকে বোঝাচ্ছেন তা স্পষ্ট হয় না।

 

প্লেটোর বিদ্যালয়ের কার্যক্রম

রিপাবলিক সংলাপে প্লেটো শিক্ষার বিস্তারিত দর্শন এবং এর সংশ্লিষ্ট পাঠ্যক্রমও উপস্থাপন করেন। প্লেটোর পরিকল্পনা অনুসারে, রাষ্ট্রের সম্ভাব্য রক্ষাকর্তাদের গভীরভাবে গণিত চর্চা করা উচিত। এর ফলে তাদের অন্তর্দৃষ্টি পরিশুদ্ধ হবে। এর মাধ্যমে তারা গুডনেস বা ভালত্বের প্রকৃতি বুঝতে পারবেন—এবং ন্যায়, জ্ঞান, সাহস ও পরিমিতি বোধের মত চিরায়ত গুণাবলী আয়ত্ত করতে পারবে। আসলে প্লেটোই প্রথম ব্যক্তি যিনি আমাদের উদ্দেশ্যে শিক্ষার একটি সুগঠিত দর্শন উপস্থাপন করেছেন।

প্লেটোর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনায় শিক্ষার যে বিস্তৃত নীল নকশা দেখানো হয়েছে, তার ভিত্তিতে অনেকেই (ভুল করে) ধরে নিতে পারে যে একাডেমিতেও একজন শিক্ষার্থীকে একই শিক্ষা দেওয়া হত। এছাড়াও, আমরা আধুনিক মানুষেরা যেহেতু বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরেই বেড়ে উঠেছি, আমাদের পক্ষে তাই ধরে নেওয়া সহজ যে প্লেটোর একাডেমিতে আমাদের সময়ের মতই নিয়মিত ক্লাস ও লেকচার হত। এই দুটি ধারণাই ভুল।

প্রথমত, প্লেটোর নিজের দৃঢ় দার্শনিক মতাদর্শ থাকলেও, তার একাডেমির উদ্দেশ্য ছিল না শিক্ষার্থীদের কোনো নির্দিষ্ট দার্শনিক মতবাদ, ধর্মমত বা কী ভাবা উচিত তা শেখানো। বরং শিক্ষার্থীদের কীভাবে চিন্তা করতে হয় সেটা শেখানোই ছিল প্লেটোর একাডেমির মূল উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়ত, প্লেটোর জীবনকালে একাডেমিতে নিয়মিত ক্লাস হতো বা আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের সাথে মেলে এমন কোনো কিছু হত, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

আসলে, প্লেটো একাডেমিতে ৪০ বছর ধরে পড়ালেও, তিনি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে মাত্র একটি বক্তৃতাই দিয়েছিলেন, যার শিরোনাম “ভালত্ব প্রসঙ্গে”। প্লেটোর ঘনিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা, যাদের মধ্যে অ্যারিস্টটলও ছিলেন, বক্তৃতাটির ওপর সতর্ক নোট নিয়েছিলেন। তবে এই বক্তৃতা শুনতে আসা বেশিরভাগ লোকই বিভ্রান্ত হয়ে চলে যায়, কারণ এটি শেষ পর্যন্ত গণিত আলোচনায় গিয়ে শেষ হয়!

এতে কোনো সংশয় নেই যে প্লেটো চেয়েছিলেন তার শিক্ষার্থীরা ভালত্বকে বুঝুক, সেই সাথে আরও অনেক কিছুই বুঝুক। তবে তার একাডেমির প্রধান কৃতিত্ব এটাই যে এটি সক্রেটিয় পদ্ধতির প্রশ্নোত্তরের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, কোনো দার্শনিক মতবাদ শিক্ষা দেওয়া একেডেমির কাজ ছিল না। জন ডিলন ব্যাপারটি বর্ণনা করেছেন এভাবে, “প্লেটোর বিভিন্ন বিষয়ে দৃঢ় মতামত থাকা সত্ত্বেও, তার উদ্দেশ্য ছিল না তার উত্তরসূরীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট মতবাদের সমষ্টি রাখা, যা তারা সবার সাথে বিতর্ক করে রক্ষা করবে।”

তিনি যা শেখাতে চেয়েছিলেন তা হল একটি জিজ্ঞাসা পদ্ধতি, যা তিনি নিজের শিক্ষক সক্রেটিসের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এই পদ্ধতি যদি সঠিকভাবে অনুশীলন করা হয়, এটি তাদেরকে সত্যের দিকে নিয়ে যাবে। সেই সত্যে প্রত্যেকে নিজে নিজে পৌঁছাবে।

জ্যামিতি বা গণিতের ওপর কিছু অনানুষ্ঠানিক কোর্স একাডেমিতে রাখা হলেও, একাডেমির সামগ্রিক গুরুত্ব ছিল সক্রেটিক সংলাপ এবং দ্বান্দ্বিক বিচার পদ্ধতির ওপরে। অর্থাৎ প্রশ্ন ও উত্তর, সঠিক সংজ্ঞা নির্ধারণ, অপ্রমাণিত ধারণাগুলি পরীক্ষা করা এবং যুক্তির ত্রুটি বের করা। (প্লেটো সংলাপ পছন্দ করতেন। তবে তার ২০ বছর বয়সী শিক্ষার্থী এরিষ্টটল পছন্দ করতেন বক্তৃতা। পরে তিনি নিজের ইচ্ছামত অন্তহীন বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে নিজের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, এবং সেখানে তিনি ইচ্ছামত বক্তৃতা দিতেন।)

প্লেটোর প্রকাশিত সংলাপগুলি নতুন শিক্ষার্থীদের স্কুলের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল বলে জানা যায়। গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন তার লেখা পড়তেন, তারপর এথেন্সের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেন। কথিত আছে, একজন শিক্ষার্থী ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি দেশ ক্যালডিয়া (বর্তমানে বিলুপ্ত) থেকেও এসেছিলেন। প্লেটোর সবচেয়ে বিখ্যাত ও উপভোগ্য সংলাপগুলির মধ্যে একটি হল ‘সিম্পোজিয়াম’। সংলাপটিতে চরিত্রসমূহ প্রেমের প্রকৃতি সম্পর্কে নিজ নিজ বক্তৃতা দেয়। হতে পারে সংলাপটি রচনা করার সময় প্লেটো একাডেমির প্রচারণার কথা মাথায় রেখেছিলেন। একাডেমিতে যে ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনা ও সঙ্গ পাওয়া যাবে তার কিছুটা বিজ্ঞাপন এই সংলাপে আছে। একাডেমি দু’জন নারী শিক্ষার্থীকেও আকৃষ্ট করেছিল। মান্টিনিয়ার লাস্থেনিয়া এবং ফ্লিউসের অ্যাক্সিওথিয়া। কথিত আছে, অ্যাক্সিওথিয়া শিক্ষার্থী হন ‘রিপাবলিক’ পড়ে। এবং নেরিনথোস, একজন কোরিন্থিয়ান কৃষক, তিনি ‘জর্জিয়াস’ সংলাপটি পড়ার পর একাডেমিতে যোগ দেন। ম্যাসেডোনিয়া থেকে আসা অ্যারিস্টটল ১৮ বছর বয়সে একাডেমিতে যোগ দেন।

প্লেটো ছাড়াও, একাডেমির অন্য সদস্যরাও সংলাপ রচনা করতেন। যার মধ্যে ছিলেন অ্যারিস্টটল, স্পিউসিপাস এবং হেরাক্লেইডিস। আমরা কল্পনা করে নিতে পারি যে, এই সংলাপগুলি সম্ভবত অন্য শিক্ষার্থীদের সাথে শেয়ার করা হত, বা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে জোরে জোরে পড়া হত যাতে এগুলি নিয়ে তারা আলোচনা করতে পারে। সক্রেটিয় চিন্তা পদ্ধতি শেখানোর জন্য এইভাবে প্লেটোর কিছু সংলাপও ব্যবহার করা হত।

প্লেটো তার একাডেমিতে সক্রেটিয় জিজ্ঞাসা পদ্ধতিতে বেশ জোর দিতেন। এ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সদগুণের প্রকৃতি ও কীভাবে জীবনকে সুন্দরভাবে যাপন করা যায় তা খতিয়ে দেখতে শিখত। এর পাশাপাশি একাডেমিতে গণিতের বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যও একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। প্লেটো তার সময়ের সবচেয়ে আধুনিক গাণিতিক আবিষ্কারগুলি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। কিন্তু আরও বিস্ময়কর হল এই সত্যটি, যে প্লেটোর জীবদ্দশায় প্রত্যেক আধুনিক গণিতবিদ একাডেমির সাথে কোনো না কোনো সম্পর্ক রেখে চলতেন। এই দলে ছিলেন এথেন্সের থিটেটাস, সিনিডাসের ইউডোক্সাস, পন্টাসের হেরাক্লাইডিস, মেনেখমাস, ডিনোস্ট্র্যাটাস, কোলোফনের হারমোটিমাস এবং ওপাসের ফিলিপ।

“জ্যামিতি না জেনে এখানে প্রবেশ নিষেধ” এই বিখ্যাত উক্তিটি একাডেমির প্রবেশদ্বারে খোদাই করা ছিল বলে প্রচলিত আছে। তবে নিশ্চিতভাবেই এটি একটি মিথ। কিন্তু প্লেটোর জীবনকালে একাডেমিতে যে আন্তরিক গাণিতিক গবেষণা চলছিল তা তাৎপর্যপূর্ণ ও সর্বজনবিদিত ছিল।

বর্তমান থেকে পেছন ফিরে দেখলে, প্লেটোর একাডেমিকে একটি বেসরকারি থিংক ট্যাংক বলে মনে হয়। যা গঠিত হয়েছিল সেই সময়ের সবথেকে অগ্রসর ও পরিণত ব্যক্তিদের নিয়ে। এছাড়া এও মনে হয়, প্লেটোর সময়ের গণিতবিদরাই ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস অফ জিওমেট্রি’ নামের বইটির বেশিরভাগ উপকরণ তৈরি করে দিয়েছিলেন। পরে ইউক্লিড নানা সম্পাদনাসহ বইটি প্রকাশ করেন।

প্রাচীন পৃথিবী থেকে যেসব তথ্য আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভালভাবে নথিবদ্ধকৃত এবং আকর্ষণীয় প্রতিবেদনগুলির মধ্যে একটি থেকে জানা যায়, প্লেটো তার একাডেমির গণিতবিদদের জন্য একজন “স্থপতি” বা “অধ্যয়ন পরিচালক” হিসাবে কাজ করতেন। অর্থাৎ তিনি একাডেমির গণিতবিদদের উদ্দেশ্যে সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট প্রশ্ন বা সমস্যা উত্থাপন করতেন।

বিখ্যাত একটি ঘটনা থেকে জানা যায়, প্লেটো একবার একাডেমির গণিতবিদদের প্রতি “গ্রহ সমস্যা” উত্থাপন করেছিলেন। চোখে আমরা যখন গ্রহগুলিকে দেখি, মনে হয় গ্রহগুলি কোনো নিয়মিত গতিবিধি ও গাণিতিক প্যাটার্ন অনুসরণ করে না। কিন্তু বাস্তবে গ্রহগুলি নিয়মিত গাণিতিক প্যাটার্ন মেনে চলে বলে প্লেটো বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি একাডেমির সদস্যদের সেই নিয়মিত প্যাটার্ন অথবা অন্তত এর একটি মডেল আবিষ্কার করার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। প্লেটোর এই চ্যালেঞ্জটি থেকেই জন্ম হয় গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের: প্রকৃতির গাণিতিক নিয়মাবলি বিষয়ক অধ্যয়ন।

আমার ধারণা এই গল্পটি একাডেমিতে প্লেটোর প্রকৃত ভূমিকা সম্পর্কে একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দেয়। তা হল, তিনি একাডেমির কোনো নির্দেশক বা বক্তা ছিলেন না, বরং তিনি বিশ্লেষণ ও সমাধান করার জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে সমস্যা ছুঁড়ে দিতেন।

তিনি গাণিতিক গবেষণার ক্ষেত্রেও এই ভূমিকা পালন করতেন। এ থেকে ধারণা করা যায়, তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও একইভাবে কাজ করতেন, নীতিশাস্ত্র ও রাজনৈতিক দর্শনেও। আসলে, আমরা তাকে তার সংলাপগুলিতে, যেমন রিপাবলিকে, এইভাবেই কাজ করতে দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় রিপাবলিক সংলাপের কথা, সেখানে প্লেটো সদগুণের প্রকৃতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করেন, এরপরে তিনি সক্রেটিয় জিজ্ঞাসা পদ্ধতি ব্যবহার করে সেই প্রশ্নগুলির সমাধান করার চেষ্টা করেন।

 

প্লেটোর একাডেমির উত্তরজীবন এবং বর্তমান সময়ে দর্শনের প্রভাব

প্লেটো ৮১ বছর বেঁচে ছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৭ সালে তিনি মারা যান। “একাডেমিতে”, সম্ভবত তার বাগানেই, তাকে সমাহিত করা হয়। নির্দিষ্ট জায়গাটি একাডেমি পার্কের কাছে অবস্থিত, তবে এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তার মৃত্যুর পর, বিখ্যাত ভাস্কর সিলানিয়ন একাডেমিতে প্লেটোর ভাস্কর্য নির্মাণ করেন, যার কয়েকটি অনুলিপি আজও টিকে আছে।

প্লেটোর একাডেমি
গবেষকরা প্লেটোর সমাধিস্থলের প্রমাণ পেয়েছেন একটি পোড়া হারকুলানিয়াম প্যাপিরাসে, যেখানে গাদারার ফিলোডেমাসের (১১০-৪০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের পর) একাডেমির ইতিহাস বর্ণিত রয়েছে। প্যাপিরাসটি আবিষ্কৃত হয়েছে নেপলসের কাছে হারকুলানিয়াম শহরে ।

একাডেমিটি একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠেছিল। একজন “প্রধান শিক্ষক” দ্বারা পরিচালিত হত। প্লেটো যখন ইতালি ভ্রমণে ছিলেন, বিখ্যাত গণিতবিদ ইউডোক্সাস অস্থায়ী ‘প্রধান শিক্ষক’ হিসাবে নিযুক্ত হন। প্লেটো মারা গেলে, তার ভাতিজা স্পিউসিপাস প্রধান শিক্ষক হিসাবে তার স্থলাভিষিক্ত হন। প্লেটোর মৃত্যুর পর, অ্যারিস্টটল খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ সালে এথেন্সের আরেকটি বিখ্যাত পার্ক লাইসিয়ামে তার নিজের বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সম্প্রতি এটি খনন করা হয়েছে এবং দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।

প্লেটো মজা করে অ্যারিস্টটলকে “দ্য ব্রেইন” বলে ডাকতেন। অ্যারিস্টটল নিজের মনমত এক অনন্য পদ্ধতিতে একাডেমির কাজ করতেন। প্লেটো পছন্দ করতেন গণিত, জ্যামিতি ও সংলাপ। আর অ্যারিস্টটল পছন্দ করতেন জীববিজ্ঞান, পদ্ধতিগত গবেষণা এবং সুস্পট ও আনুষ্ঠানিক তর্ক। আসলে, অ্যারিস্টটলের এই সমন্বিত গবেষণা কার্যক্রমগুলিই আলেকজান্দ্রিয়ায় গ্রন্থাগার ও জাদুঘর স্থাপনের অনুপ্রেরণা জোগাতে সাহায্য করেছিল।

প্লেটোর ভাতিজা স্পিউসিপাসের পরে একাডেমিতে অন্য প্রধান শিক্ষক আসেন। তারপরে আরেকজন। এভাবে কয়েক দশক ও শতাব্দী জুড়ে অনেক অনেক প্রধান শিক্ষক একাডেমি পরিচালনা করেন। সংখ্যায় তারা প্রচুর, তাদের তালিকা এখানে দেওয়া অসম্ভব।

একাডেমির কোনো নির্দিষ্ট দার্শনিক বিশ্বাস ছিল না। একাডেমিতে গুরুত্ব দেওয়া হত সমালোচনামূলক জিজ্ঞাসার ওপরে। ফলে, একাডেমিক চিন্তার ধারা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে, একাডেমির সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সময় ছিল প্লেটোর সময়কাল, যখন সেখানে অ্যারিস্টটলও ছিলেন।

প্লেটোর একাডেমি
খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর রোমান মোজাইকে প্লেটোর একাডেমি। মোজাইকটি পম্পেইর ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বর্তমানে এটি নেপলসের মুসেও নাজিওনালে আর্কেওলজিকোতে সংরক্ষিত রয়েছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৮৬ সালে, রোমান জেনারেল সুল্লা, লুটপাট চালিয়ে নির্মমভাবে এথেন্স নগরী আত্মসাৎ করেন। হামলার সময়, তিনি একাডেমি পার্কের লম্বা গাছগুলি সব কেটে ফেলেন। পার্কের পবিত্র কুঞ্জবনের সেইসব গাছের কাঠ যুদ্ধের যন্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করেন। শিক্ষাকেন্দ্র হিসাবে একাডেমির শারীরিক সমাপ্তি এভাবেই ঘটে। আর এথেন্সের একটি প্রচলিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে, এটি সম্ভবত কয়েক বছর আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যখন একাডেমির শেষ প্রধান শিক্ষক লাহিসার ফিলো মিথ্রিডেটিয় যুদ্ধ এড়াতে রোমে পালিয়ে যান।

এত এত বাধা-বিপত্তি ও ধ্বংসাত্মক সব ঘটনার পরেও প্লেটোর দর্শন অক্ষত আছে। প্লেটোর দর্শন প্রাচীন বিশ্বের অগণিত চিন্তাবিদকে প্রভাবিত করে, অনুপ্রাণিত করে। এটি স্টোয়িকবাদী দার্শনিকদের প্রভাবিত করে। প্রভাবিত করে সিসেরোকে। এর থেকে নব্য-প্লেটোবাদী দার্শনিক ধারা তৈরী হয়। ১৪, ১৫, ১৬ শতকে ইউরোপে নবজাগরণের সময় প্লেটোর দর্শন পুনরায় আবির্ভূত হয়। নবজাগরণের সময় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও মানবিকতার যে পুনঃজাগরণ ঘটে, প্লেটোর দর্শন তার উর্বরতা আরও বাড়িয়ে তোলে।

অ্যালফ্রেড নর্থ হোয়াইহেড এর একটি বিখ্যাত উক্তি এমন, “ইউরোপীয় দার্শনিক ঐতিহ্যের সবচেয়ে নিশ্চিত সাধারণ বৈশিষ্ট্যটি হল এটি প্লেটোর বইয়ের পৃষ্ঠার নিচে প্রদত্ত রাশি রাশি টীকা দিয়ে গঠিত।” কারণ প্লেটো যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছিলেন, সেগুলি আজও সক্রিয়ভাবে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এবং এগুলি নিয়ে বিতর্ক এখনও চলমান। একইভাবে, সত্য, সৌন্দর্য, ভালত্ব ও সদগুণ বিষয়ে দার্শনিক অনুসন্ধানের জনপ্রিয়তা কখনও কমেনি। যদিও প্লেটোর সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এসব বিষয় যেমন কম আলোচিত হত, এখনও তাই।

যুদ্ধের নামে সুল্লা একাডেমাস পার্কের গাছপালা সব ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু প্রাকৃতিক নবজন্মলাভের চিরনিয়মের মাধ্যমে সেই গাছপালা আবারও সেই আগেরই মত সুন্দর হয়ে উঠেছে। আমরা এখন এথেন্সের সেই একাডেমাস পার্কের শান্তিপূর্ণ, ছায়াময় পথ ধরে হাঁটতে পারি। শুনতে পারি ঘুরঘুরে পোকা আর ঝিঁঝিপোকার ডাক। প্রাচীন দর্শনের প্রতি বা শিক্ষার গভীর দিক নিয়ে যারা আগ্রহী তাদের জন্য এই ভ্রমণ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

এই পথে হাঁটা মানে আক্ষরিক অর্থেই ইতিহাসের সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ী কিছু মানুষের পদচিহ্ন ধরে হাঁটা। প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সেইসব গ্রিক গণিতবিদরা; আর পরবর্তীকালের সিসেরো, প্লুটার্ক ও মার্কাস অরেলিওসের মত ব্যক্তিরা; এবং অন্যান্য সবাই যারা পশ্চিমা দর্শন ও বিজ্ঞানের এই উৎপত্তিস্থলে মিলিত হয়েছিলেন—যারা বিশ্বাস করতেন, “যে-জীবন প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করা হয় না, তা যাপনের যোগ্য নয়।”


লেখক পরিচিতি
ডেভিড ফিডেলার প্রাচীন ও রেনেসাঁ যুগের ধারণাগুলি আজকের পৃথিবীতে কীভাবে প্রযোজ্য হতে পারে তা নিয়ে লেখালেখি করেন। দর্শন ও বিজ্ঞানের ইতিহাসে পিএইচডি করেছেন, শিক্ষার দর্শনে তার আগ্রহ দীর্ঘদিনের। প্লেটোর একাডেমি ও অন্যান্য গ্রিক দার্শনিক স্কুলের ইতিহাস নিয়ে পাঠ্যবই লিখেছেন। উল্লেখযোগ্য বই ‘ব্রেকফাস্ট উইথ সেনেকা: এ স্টোয়িক গাইড টু দি আর্ট অফ লিভিং’। তিনি কলেজ অধ্যাপক, সম্পাদক, প্রকাশক, শিক্ষাগত পরামর্শদাতা এবং মানবিক কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।