কথাসাহিত্যিক, কবি ও অনুবাদক মাসরুর আরেফিনের জন্ম বরিশালের আমানতগঞ্জে, ৯ অক্টোবর ১৯৬৯ সালে। পড়াশোনা করেছেন বরিশাল ক্যাডেট কলেজ, ভারতের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেলবোর্নের ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে। বিভিন্ন সময়ে তার শিক্ষার বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য এবং মার্কেটিং ও ফিন্যান্স।

মাসরুর আরেফিনের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি: ‘ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প’ (২০০১); ‘পৃথিবী এলোমেলো সকালবেলায়’ (২০২০); ‘পরিস্থিতি যেহেতু আগুন হয়ে আছে’ (২০২১)। অনুবাদের বই দুটি: ‘ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র’ (২০১৩) এবং ‘হোমারের ইলিয়াড’ (২০১৫)। উপন্যাস চারটি: ‘আগস্ট আবছায়া’ (২০১৯), ‘আলথুসার’ (২০২০), ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ (২০২১); ‘আড়িয়াল খাঁ’ (২০২২)। ২০২৩ সালে বের হয় ইকতিজা আহসানের নেওয়া মাসরুর আরেফিনের সাক্ষাৎকারের বই: ‘মানবতাবাদী সাহিত্যের বিপক্ষে’। সামনে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তার নতুন উপন্যাস ‘দূর বৃত্ত’।

বর্তমানে তিনি সিটি ব্যাংকের এমডি ও সিইও হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। সংসারে আছে স্ত্রী ফারহানা মাসরুর অনি এবং দুই মেয়ে মালাগা ও নিওবি এবং তিন বিড়াল মার্সেল প্রুস্ত, মাফিন প্রুস্ত ও মোকা প্রুস্ত।

সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে ৫ অক্টোবর শনিবার, মাসরুর আরেফিনের অফিস কক্ষে। মোট তিন পর্বে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ এটি। সঙ্গে থাকছে ইউটিউব ভিডিওর লিংক।

মাসরুর আরেফিনের সঙ্গে আলাপ

ব্রাত্য রাইসু


(পর্ব ১)

ব্রাত্য রাইসু: হ্যাঁ মাসরুর, কেমন আছেন?

মাসরুর আরেফিন: চলছে, ভালই আছি। অনেক কিছু নিয়া। আশা করি আপনিও ভালই আছেন।

রাইসু: এমনিতে তো ধরেন আমাদের দুইজনের কথাবার্তা, এটা আনুষ্ঠানিক হওয়ার ব্যাপারও না, কিন্তু আমরা তো এখন আনুষ্ঠানিক।

মাসরুর: আমার জন্য একটু অন্যরকম৷ আমার তো সাক্ষাৎকারের বইটা ইকতিজা আহসানের নেওয়া। আমার চেয়ে বয়সে কম। আমাকে ধরেন গুরু মানে। তো সেই জায়গায় ইন্টারভিউ এক জিনিস আর আপনি ব্রাত্য রাইসু। আপনি সাক্ষাৎকারে তো, সাক্ষাৎকার সাহিত্যে আপনার অন্য রকম নাম-সুনাম, সো এ মুহূর্তে একটু নার্ভাস, বাট দুই মিনিটের মধ্যে চলে যাবে। এন্ড অফ দ্য ডে উই আর ফ্রেন্ডস, সো অসুবিধা নাই। আপনি যদি আমাকে প্রশ্নগুলো একটু আগে বলতেন একটু ভাল হতো, বাট বলেন নাই, এই আরেক সমস্যা, দেখা যাক।

রাইসু: না, আপনি তো দীর্ঘদিন ফেসবুক কিংবা সাহিত্যের জগতে নাই। এটার কারণটা কী, অফিসের চাপ?

মাসরুর: কারণটা আসলে, ফেসবুকের জগতটা বেশি, আমার কাছে মনে হল, হইচই এর। এই হইচইটা আমার পড়াশোনার যে অভিনিবেশ, সেটা নষ্ট করা শুরু করল। এবং ওইখানে ছোট ছোট কমেন্ট আমাকে উত্তেজিত করা শুরু করল। এবং লেখকের কাজ সমাজে চলা, সার্বিক হইচই-চিৎকার কত কিছুই তো চলছে, সেগুলো নিয়ে লেখা। বাট লেখক একজন ইন্টারেস্টিং সত্তা, যে লিখবে আওয়াজ নিয়ে, বাট তার মাথা থাকতে হবে সবচেয়ে ঠাণ্ডা।

তো লেখকের যে চিন্তার ভিতরে, মাথার ভিতরে যে বাগানটা, ওইটা একদম স্থির সুন্দর থাকতে হবে। মৌমাছির একটা ভোঁ ভোঁ গুন গুন থাকলেও ঠিক হবে না। তো এই জায়গাতে ফেসবুক আমার কাছে মনে হল যে আমি একটা মানুষ যে কিনা মাথা ঠাণ্ডা করে গরম বিষয় নিয়ে লিখছে। যেহেতু চারপাশে এত বেশি গরম! এবং যার লেখার অভিমুখটা ধরেন প্রভোক করা, বিভিন্ন বিষয়ে। তাকে মাথা আরও ঠাণ্ডা তো রাখতেই হবে।

মাসরুর আরেফিন

আসলে ভাল লেখকের, আমি জানি না আমি ভাল কিনা, মাথাটা ভলকানোর মতো থাকা উচিত। ভিতরে আগুন থাকবে, কিন্তু হৃদয়ে চিন্তায় মাথা থাকবে ঠাণ্ডা। ভলকানো বাইরে থেকে দেখে স্রেফ একটা পাহাড় বলেই তো মনে হয়। তো ওই জায়গায় ফেসবুক আমাকে একটু বিচলিত করা শুরু করল। আমার মনে হল আমার বাগান বা আমার ভলকানোটার শেইপ সাইজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই দূরে গেলাম, কিন্তু দূরে গিয়ে দেখলাম আর এক সমস্যা। এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগের অভ্যাস অভ্যস্ততা এগুলা একটা বড় বিষয়। দূরে গিয়ে দেখলাম দূরত্ব বাড়ছেই, টোটাল সাহিত্য জগতে কী চলছে… বিকজ বাইরে যা চলছে সেটা জানাটাও তো ইম্পরট্যান্ট…।

রাইসু: ফেসবুকে যা চলতেছে সেইটা আপনি অফলাইনে জানতে পারতেন কিনা?

মাসরুর: অফলাইনে জানাটার জন্য কারও সাথে কথা বলতে হয়, কিন্তু সেই সময় নাই। ফেসবুক একটা অভ্যাসের বিষয় ছিল—দেখতাম পড়তাম, দেখা গেল…।

রাইসু: কিন্তু আপনার বন্ধু-বান্ধবের অধিকাংশই তো হচ্ছে সাহিত্যের লোক, এবং প্রত্যেকেই ফেসবুক তারা করেন।

মাসরুর: তাদের চিন্তাগুলো ধরেন আমি জানতে পারছি না। হয় কী, ফেসবুক অনেকটা তো এনলাইটেনমেন্টের একটা জায়গা। এই অর্থে যে, আপনি সেখানে আপনার মতামত প্রকাশ করছেন এবং গালিগালাজ দিলেও আপনি যেটা পছন্দ করেন না সেটাকে গালি দিচ্ছেন৷ অর্থাৎ আপনার মধ্যে একটা শুভ’র চিন্তা থাকছে। ফেসবুকে আল্টিমেটলি সবার উদ্দেশ্য যার যার জায়গা থেকে সমাজটাকে আরেকটু বেটার করা।

এই জায়গা থেকেই আমার—খারাপের বিষয়টা বলি—এই যে এনলাইটেনমেন্ট ধরেন ফেসবুক, এই এনলাইটেনমেন্টের টোটালিটারিয়ান একটা রূপ আছে। এবং এনলাইটেনমেন্ট অ্যাকচুয়ালি টোটালিটারিয়ান। এইটা বোঝা থেকে ফেসবুককে ভয় পাওয়া শুরু করলাম। যে সে আমাকে গ্রাস করছে!

এই যে এনলাইটেনমেন্ট ধরেন ফেসবুক, এই এনলাইটেনমেন্টের টোটালিটারিয়ান একটা রূপ আছে। এবং এনলাইটেনমেন্ট অ্যাকচুয়ালি টোটালিটারিয়ান। এইটা বোঝা থেকে ফেসবুককে ভয় পাওয়া শুরু করলাম।

আমি জানি না আপনাকে বোঝাতে পারছি কিনা। এই ফেসবুকের টোটালিটারিয়ান অ্যাসপেক্ট যে, সে আমার চিন্তার বাগানে ঢুকে যাচ্ছে। আমার সাহিত্য নষ্ট হচ্ছে। আমাকে বিরক্ত করছে, এবং আমাকে হাত বাঁধা বলে মনে হচ্ছে আমার নিজের। কারণ আমার কমেন্ট লোকের কেমন লাগছে আমি সেটা পরিমাপ করছি। আমি একটা পোস্ট করছি, লোকে ভাল বলছে নাকি খারাপ বলছে সেটা পরিমাপ করছি। সাহিত্য এইভাবে দৈনন্দিন বেসিসে পরিমাপের কোনো বিষয়ই না।

ফেসবুক আমাকে ওই জায়গাটাতে ঠেলে নিয়ে গেছিল। এইটা ট্র্যাপ৷ মনে হল এই ট্র্যাপ থেকে বের হই। বের হওয়ার পরে এই ট্র্যাপটা… থাকে না কিছু ইঁদুর, একটা গর্তের মধ্যে সে থাকে, সে জানে না ওইটা একটা ট্র্যাপ, সে জানে ওইটা একটা গর্ত, ইঁদুরের জায়গা থেকে দেখলে ওইটা একটা গর্তই, আর আমার জায়গা থেকে দেখলে ওইটা ওকে ধরার ট্র্যাপ, আমি ওকে চাইলেই ধরে ফেলতে পারি। ফেসবুক অনেকটা তাই।

রাইসু: আপনি কি ফেসবুক থেকে মুক্তি পাইছেন মনে করেন?

মাসরুর: না,আবার এখন মনে হচ্ছে যে, এই মুক্তি নিতে গিয়ে, এই মুক্তিটা নিতে গিয়ে… কাজের কাজ একটা হইছে যে সময়গুলা পাওয়া গেছে পর্যাপ্ত পড়াশোনা করার, এটা সত্যি কথা। বাট ফেসবুক নিজেও আর একটা পড়াশোনার বই। এই জিনিসটা আই হ্যাভ বিন মিসিং, এই জিনিসের জন্য ইদানীং কালে আবার মাঝে মধ্যে ফেসবুকে যাচ্ছি। এখন তো বুঝতেই পারছেন যে দেশে অনেক কিছু এখন চলছে৷ দেশ একটা ট্রানজিশনের মধ্যে আছে। এই সময়ের আসল সত্য, মনের কথা, যা পত্রিকাগুলো বলার জন্য রেডি না।

কারণ আমাদের পত্রিকার ভাষা একরকম আর ফেসবুকের ভাষা তো একেবারে ডিফারেন্ট, আরেক রকমের। তো একটা গ্রুপ যারা এত বড় আন্দোলন ঘটাল, দে আর আরটিকুলেটিং একটা নতুন ভিশন। যে মুহূর্তে কোনো নতুন ভিশন আর্টিকুলেট হয় পৃথিবীতে, দেয়ার আর ডেঞ্জার্স অব আরটিকুলেটিং এ নিউ ভিশন। সো এই ডেঞ্জার দেখার লোভে এখন আবার আমি একটু একটু ফেসবুকে…।

রাইসু: যান, কিন্তু লেখেন না?

মাসরুর: না লিখছি না, লিখছি না। শুধু বিপদগুলো বোঝার চেষ্টা করছি। আমার কাছে মনে হচ্ছে যে ইটস এ ওয়ার। দ্য ওয়ার ইজ অন, ওয়ার গোয়িং অন।

রাইসু: আপনার ফেসবুকের স্মৃতি অনুসারে, তখন যেরকম ছিল আগে, আর এখনকার অবস্থাটা একটু চেঞ্জ হইছে বইলা মনে করেন?

মাসরুর: ফেসবুকের?

রাইসু: পরিস্থিতি, ফেসবুকের যে অবস্থা, বিশেষত গণ আন্দোলনের পরে ফেসবুকে কথা বলার ক্ষেত্রে কোনও ভিন্নতা আসছে কিনা মানুষের মধ্যে?

মাসরুর: কথা বলার ক্ষেত্রে ভিন্নতা আসছে রাইসু, আপনি জানেন যে, হাউ আই ওয়াজ হ্যারাস্ড ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসের পরে।

রাইসু: কী হইছিল তখন?

মাসরুর: ঢাকা লিট ফেস্টে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাস নিয়ে আমি এবং এক ইন্ডিয়ান ভদ্রলোকের বটতলাতে বা ওই যেকোনো একটা বিল্ডিংয়ের ওখানে, প্রায় দেড় দুইশ মানুষ ছিলেন… আমাকে নিয়ে একটা সেশন ছিল, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে কী বলতে চেয়েছি, রাশান কবি অসিপ মান্দালস্তামের মৃত্যু, স্টালিনের হাতে… তো এটা বলতে গিয়ে আই টকড অ্যাবাউট ইউ নো যে—এ দেশে তিনটা জিনিস নিয়ে লেখা যায় না। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ তো আসলে কার্টুনিস্ট মুশতাক ভাইয়ের মৃত্যু। আমারই ছোটভাই কিশোর কবীরের আজীবনের জন্য তছনছ হয়ে যাওয়া—যিনি এঁকেছিলেন কার্টুনটা আর মুশতাক ভাই ক্যাপশন করেছিলেন। এটা নিয়েই আসলে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ এবং যথেষ্ট জায়গায় ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’-এ এই জিনিসটা স্পষ্ট আছে। তো আমার বাহনটা ছিল এটা প্রকাশের জন্য ওসিপ মান্দালস্তামের, রাশান ওই কবির রাষ্ট্রীয় খুন নিয়ে লেখাটা লেখা।

তো এটা নিয়ে প্রচুর ওখানে কথা বলি, ওই মঞ্চে। যে কেন আমাদেরকে এই সিম্বলের বা অন্য কোনো কিছুর উপরে ভর করতে হচ্ছে? প্লাস একটা কথা বলি যে, তিনটা জিনিস এ দেশে লেখা ও বলা নিষিদ্ধ। লেখকের জন্য, কথা বলা মানে লেখা। একটা হচ্ছে সেক্স, এটা চিরকালীন নিষিদ্ধ। বাঙালি ইউলিসিস এর মতন কোনও সেক্সুয়াল কিছু জীবনেও লিখতে পারবে না। আরেকটা হচ্ছে পলিটিক্স, নিষিদ্ধ না। তবে সরকার নিয়ে বলা নিষিদ্ধ। কিন্তু রাষ্ট্র নিয়ে বলা ওকে। আর হচ্ছে ধর্ম নিয়ে বলা নিষিদ্ধ। একটা সাহিত্যিক যেভাবে মন খুলে ধরেন বলতে চাইবে…। তো এই কথাগুলো ওখানে ছিল। আমি বললাম, যদি আমি ধরেন এখানে এটা বলি…।

আসলে ভাল লেখকের, আমি জানি না আমি ভাল কিনা, মাথাটা ভলকানোর মতো থাকা উচিত। ভিতরে আগুন থাকবে, কিন্তু হৃদয়ে চিন্তায় মাথা থাকবে ঠাণ্ডা। ভলকানো বাইরে থেকে দেখে স্রেফ একটা পাহাড় বলেই তো মনে হয়।

রাইসু: এমনিতে সামরিক বাহিনী নিয়েও তো বলা নিষিদ্ধ।

মাসরুর: সামরিক বাহিনী নিয়েও বলা নিষিদ্ধ বলতে তো সরকার নিয়ে বলা নিষিদ্ধ। সামরিক বাহিনী তো সরকারের অংশের মধ্যে… সামরিক বাহিনী যদিও রাষ্ট্রের মধ্যে পড়ে, বাট বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও সরকার বেশ একাকার অবস্থায় ছিল, একাকার অবস্থায় আছে। সো এই তিনটা জিনিস বলা নিষিদ্ধ, দেন আই মেইড এ কমেন্ট যে বাংলা একাডেমির ওই আমি গেটেও পৌঁছাতে পারব না যদি আমি এগুলো নিয়ে কথা বলি। তার আগেই আমাকে অ্যারেস্ট করা হবে।

তারপর এটার পরেই যেটা হল যে ডিজিএফআই ঢাকা ডেট, ঢাকা ডিট্যাচমেন্ট, একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল উনি নেতৃত্বে। মেইন ডিজিএফআই এর বিশাল যে বিল্ডিং তার অনেক আগে, ক্যান্টনমেন্টের মেইন রাস্তার উপরে যে বিল্ডিং, ঢাকা ডেট । ডিজিএফআই ঢাকা ডেট স্টার্টেড টু নক মি—ওই মঞ্চে আমি কী বললাম এগুলি! দেন তাদের মধ্যেও ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ও তারা কিছুটা পড়ল। আমি জানি না কতটুক তারা পড়েছে। কিছু জিনিস ছিল বইয়ের ব্যাক কভারে যেটা, যেটা, যেটা পড়তে চাই। একটু এখন, যদি পড়তে পারি।

রাইসু: হ্যাঁ, পড়তে পারেন।

মাসরুর: আমার লেখা তো একটু ভেতরে ঢোকা টাফ। ব্যাক কভারে লেখা ছিল এই উপন্যাসের মূল কথা। লেখা ছিল: এই সময়, এই কাল, যা এক বুনো পশু যার মেরুদণ্ড ভাঙা, তাই সে নিষ্ঠুর, তাই সে প্রতিহিংসাপরায়ণ, তাই সে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন নিয়ে উচ্চাভিলাষী, কিন্তু আপনাকে কথা বলতে না দেওয়ার ব্যাপারে মরীয়া। আর একটা ছিল যে, তৃতীয় উপন্যাসে মাসরুর জানতে চাইছেন কারা চালায় পৃথিবী, কীভাবে তা চালায় তারা এবং কেন তা ওভাবেই চালায়। আর কেন ঠিক নির্দিষ্ট একভাবে সিস্টেমটা চলে বলেই টিকে থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থা। কী সেই সিস্টেম… তো এই জাতীয় জিনিস। সবকিছু মিলে আমাকে বলা হল, আমাকে এ সবে প্রচণ্ড সাবধান থাকতে হবে।

ডিজিএফআই বলল, আমি দেশের বড় একটা ব্যাংকে আছি, তাও ব্যাংকের সিইও হিসাবে। আমার এই বিষয়গুলো বুঝতে হবে, আমাকে বুঝে চলতে হবে। দেন, দুঃখজনক যে আমি চাকরি ছাড়ার জন্য এখনও, বা তখনও রেডি ছিলাম না। একটা প্রস্তুতি থাকতে হয় মানুষের, এতদিনের আমি ক্যারিয়ার ব্যাংকার।

তো আমি লেখালেখি নিয়ে সাবধান হওয়া শুরু করলাম, ওই সাবধান হতে গিয়েই কিন্তু নেক্সট বইটা খেয়াল করেন শৈশব নিয়ে লিখলাম। একেবারে ডিজিএফআই খুশি হওয়ার মত বই, ‘আড়িয়াল খাঁ’। আমার কিন্তু কাজ করা উচিত ছিল ‘স্কয়ার ওয়ান’ উপন্যাসটা নিয়ে। যেটা আপনার প্রথম আলো ঈদসংখ্যায় এসেছিল। আমার উচিত ছিল আমার অন্য যেগুলো ঈদসংখ্যায় এসেছিল, সেগুলো নিয়ে কাজ করা৷ তা না করে, শৈশবে চলে গেলাম, সেফ নিরাপদ সাবজেক্টে চলে গেলাম।

দুঃখজনক যে, এই সেম ডিজিএফআই, আমার ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানকে, ব্যাংকের চেয়ারম্যান তো বোঝেনই বোর্ডের পরিচালনা পরিষদের সবার চিফ, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি একটা অন্য রকম সত্তা। ওনাকে উনারা আবার কমপ্লেইন দিলেন—আপনার এমডিকে সাবধান করেছি আমরা, আপনাকে পুরোটা একটু জানালাম। উনি জাপানে ছিলেন। ওখানে সরকারি একটা ট্রিপ ছিল। ওখানে তারা আমার চেয়ারম্যানকে এই কথা বললেন।

আরও খারাপ লাগল যে, কোনও একটা বিয়েতে দেখা হল ঢাকা ডেটের জেনারেলদের সাথে। তারা ওইখানেই “হ্যালো, কেমন আছেন?” “ভাল আছেন?” বলে খোঁচা এবং খোটাও দিল বেশ। সবার সামনেই বোঝাতে যে, মানে তারা একজন লেখককে ঠিকই সাইজ করে নিয়ে এসছেন। সো একধরনের হাসি ঠাট্টার মধ্যে খোটা। আমি আস্তে করে জায়গাটা ত্যাগ করলাম। ওখানেও আমার চেয়ারম্যান ছিলেন আমার সাথে। তো, এই পর্বও গেছে আমার জীবনে। আমি জানি না একথা কী জন্য আসলো। সো, এখন যেটা হয় যে…।

রাইসু: মানে আপনার লেখালেখি, ফেসবুকে আসা কেন আপনি বন্ধ করলেন?

মাসরুর: এই ডিজিএফআই এর ধমক, ফেসবুকে না আসার এটাও কিন্তু কারণ। বাট দিস ঈজ এ মাইনর রিজন, বিগার রিজন ইজ যে, ফেসবুক যে আলো জ্বালাতে চায়, যে আলোর মধ্যে একটা সর্বগ্রাসী কিছু একটা আছে। যেটা আমি একটু আগে একটা কথা বললাম না, যে এনলাইটেনমেন্ট ইজ টোটালিটারিয়ান। সো এগুলো তো আপ্তবাক্য টাইপের। তো এইসব মিলিয়ে একটু দূরে আছি। বাট, লেখালেখিতে ফিরতেই হবে, এখন ফেসবুকে আমার মনে হয় না কোনও ঢাকা ডেট আমাকে ফোন করবে, ঢাকা ডেট অব ডিজিএফআই।

রাইসু: এমনে আপনার যে প্রথম উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’, সেইটা নিয়া কি আপনি সরকারের কোনও রকমের বিরোধিতা বা কোনো সমালোচনার সম্মুখীন হইছিলেন কিনা? অনেকের ধারণা হচ্ছে যে, আগস্ট আবছায়া উপন্যাসটা, যেহেতু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়া—ফলে আপনি তাদের কোনো, সহযোগিতা বা তাদের কোনো ইয়ে পাইছেন কিনা, মানে সাপোর্ট পাইছেন কিনা, সমর্থন?

মাসরুর: আগস্ট আবছায়া আমার জন্য এই মুহূর্তে, এই মুহূর্তে, আগে ছিল গর্বের জায়গা, এখন ইরিটেশন।

রাইসু: কেন?

মাসরুর: কারণ হচ্ছে, ফেসবুকে তিন চারটা পোস্ট দেখেছি। ইউ নো আগস্ট আবছায়া নামটার মধ্যে আগস্ট আছে, সবাই জানে কী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ওপরে বই। তো এটার সাথে বাঙালি যেটা ইজিলি করে ফেলে বই না পড়ে যে, সমাজে তো অনেক গ্রুপ, না? সবাই তো আর সবকিছু বুঝে বলছে না। এদের মধ্যে এই প্রবণতা হয়ে গেল, এবারের পাঁচই অগস্টের পরে, নতুবা ওই পোস্টগুলো কেন আসবে? পোস্টগুলো এমন যে, একে সিটি ব্যাংক থেকে বিদায় করা হোক, এই লোক আগস্ট আবছায়ার লেখক। আগস্ট আবছায়া স্বৈরাচারের দোসর ইত্যাদি। আমি শিওর আপনি দেখেছেন।

তো তিনটা বা চারটা পোস্ট দেখলাম। যেখানে যাই আমি বুঝতে পারি, ফিল করি। বাট ইদানীংকালে আবার সবাই বোঝা শুরু করেছে। বিকজ আমিও বললাম কয়েকজনকে, একজন আমাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, খুব বড় মাপের মানুষ, যে এটা নিয়ে আমি চিন্তিত কেন? আমি বললাম, না, চিন্তিত না। নিরাপত্তার বিষয়, কিন্তু এই লেখার জন্য তো অনিরাপদ কোনও কিছু হয়ে যায় না, এটা একটা পিওর সাহিত্যকর্ম।

১৯৭৫ এর নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখা, ১৯৭৫-এ’ই গল্প শেষ। এটা শেখ হাসিনার, ইউ নো, মাছ চাষের ভূমিকা বা শেখ রেহানার জাতীয় উন্নয়নে অবদান অর শেখ মুজিবের ইউ নো, কৃষিতে অবদান, এরকম তো বিশ হাজার বই নিশ্চয়ই লেখা হইছে গত ১৬ বছরে, না? এটা তো তা না। দিস ইজ এ পিওর সাহিত্য। এটার সাথে তো, আওয়ামী লীগও তো এটার মধ্যে নাই।

এটা একটা সহিংস হত্যাকাণ্ডের, সহিংসতার রূপটাকে ধরা যে, পাওয়ারে যখন কেউ থাকে আবার যারা থাকে না, তারা কেন কন্টিনিউয়াস একে অন্যকে আসলে কিল করতে চায়। এটা তো একটা, আগস্ট আবছায়া তো ইনফ্যাক্ট, ওই হত্যাকাণ্ড নিয়েও না তো। ওই হত্যাকাণ্ড, পরে যে আবার হত্যাকাণ্ড হবে তার ভবিষ্যদ্বাণী। শেষ অধ্যায়ে যা যা কিছু… সেই নায়িকা মেহেরনাজ নর্থ কোরিয়া চলে যায়। আবার আরেক সংগ্রাম শুরু করে সুরভী ছেত্রি অ্যামস্টারডামে।

আগস্ট আবছায়া ইজ অ্যাবাউট পলিটিক্স, আগস্ট আবছায়া ইজ অ্যাবাউট পাওয়ার, আগস্ট আবছায়া বেসিক্যালি এক কথায় বললে যে, পাওয়ার একটা কন্টিনিউয়াস ওয়ার সিচুয়েশন। আগস্ট আবছায়া একটা সহিংস ঘটনা বলতে গিয়ে, একটা ওয়ার সিচুয়েশনের পৃথিবীর একটা রূপ, যার কেবল চল্লিশটা পৃষ্ঠা ওই উনিশশ পঁচাত্তরের। একটা মানুষের তার পরিবার পরিজনসহ গুড়ায়া যাওয়া।

আমার পার্সোনাল অবসেশনের জায়গা বঙ্গবন্ধু, অ্যান্ড তার এই মৃত্যু। তো একটা দেশ তো আমরা পেলাম, একাত্তর তো মিথ্যা না। একাত্তরে তো বিশাল একটা ঘটনার পরিক্রমার পরে এক সময় আমাদের স্বাধীনতা আসে। তো ওই জিনিসটা এক রকম। বাট এ বই একাত্তরেরও বন্দনা না, এটা ওনার কোনো একাত্তরে দেশ স্বাধীন করার কোনো বিষয়ও না। বাট একটা জিনিস আগস্ট আবছায়ার এক জায়গায় আমি বলেছি—এই বইয়েরই একটা জায়গায় আছে যে, বাংলাদেশে একটা বিভাজন রেখায় জাতি বিভক্ত।

মানে সো কলড প্রগতিশীল, লিবারেল মাইন্ডেড পিপল ভার্সেস ধর্মীয় চিন্তার, ধর্মকে রাষ্ট্রে নিয়ে আসার বা ফোর্স হিসাবে চিন্তা করা পিপল। বাংলাদেশ এ জায়গায় বিভক্ত। আমাদের সেকুলার এবং আমাদের মুসলিম সত্তার মধ্যে, আমাদের পাকিস্তান ভেঙে দেশ হওয়া তো, এই দেশের জন্ম তো খুবই…।

রাইসু: যদি জিজ্ঞেস করি যে, ধরেন এখন তো…।

মাসরুর: না আমি একটু আগস্ট আবছায়ার আরেকটা লাইন শেষ করি। সো, এখন আমি আসলে আর চিন্তিত না। আগস্ট আবছায়া আমাকে চিন্তায় ফেললে আসলে দিস উইল বি অ্যানাদার মিলান কুন্ডেরার জোক। একদম একটা কৌতুক হবে। এটা নিয়ে আপনি বললেন যে কোনো সুবিধা নিয়েছি কিনা কোথাও। কোনও দিনও না। আমার আগস্ট আবছায়া উপন্যাস আছে, এটা প্রধানমন্ত্রী ঠিকভাবে জানতেন কিনা, তার বোন জানতেন কিনা আমার ডাউট আছে।

আপনি আমাকে চেনেন যে, আমি জেনুইন কথাসাহিত্যিক বা জেনুইন লেখক। জেনুইন সাহিত্যিক, আমার সাহিত্য বিক্রি করে… নো এর সাথে কোনও কিছুরই কোনও সম্পর্ক নাই। আর বাংলাদেশে যারা ক্ষমতায় উপরে ছিল, যারা এখন দেশে নাই বা জেলে, তারা আমরা সাহিত্য কী লিখি, তারা জানেও না৷ তাদের ওটা বিষয়ও না। তাদের বিষয়, সিটি ব্যাংক এমডি আমার লোনটা দিবে কিনা। তারা বরং আমার ব্যাংক থেকে হয়তো সরে যাবে যদি জানে যে, এটা আবার লেখক। লেখক আবার কী জিনিস!

সো, আপনাকে বুঝতে হবে, কোন দেশের কনটেক্সটে আপনি কথা বলছেন। এখানে আন্দ্রে মালরো নাই, যিনি কিনা আপনার কালচারাল মিনিস্টার। সো, এই দেশে সাহিত্যিকের বিষয়ে এই যারা দুঃশাসনের সহযোগী, তাদের কাছে সুবিধা চাইবেনই বা কেমনে আর এটাকে দিয়ে তারা সুবিধার দেনা পাওনার বিষয়ের মধ্যে আপনার সাহিত্যকে কখনও আনবেও না।

যদি তাই হতো, পার্সোনালি আমি মনে করি যে, যদি ওটা করতাম, যদি ওরকম চেষ্টা করতাম, যেহেতু আমি হাইলি কানেক্টেড, অনেক দূর হয়তো এই আগস্ট আবছায়া বিক্রি করেই যেতে পারতাম।

“আগস্ট আবছায়া ইনিশিয়ালি বের হচ্ছে আপনার পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া থেকে। আগস্ট আবছায়ার জন্য অন্য এজেন্টও আছে। আগস্ট আবছায়া আপনার ইন্টারন্যাশনালিও আটলান্টিকের এপার ওপার থেকে দু’পার থেকে বেরোবে।”

আসলে তো, রিয়াল সাহিত্যিক কি আবার ক্ষমতার কাছে যাবে নাকি কোনেদিন? এ তো অসম্ভব যে, সাহিত্যিক আবার ক্ষমতার কাছে যাবে! আমাদের কাজই তো ক্ষমতার বিষয়টার ক্রিটিক করা, তাই না? আমার সাহিত্যের একটাই তো অভিমুখ যে, বোঝা, যে ফিজিকাল পাওয়ার, কালচারাল পাওয়ার, মতাদর্শিক পাওয়ার, ভাবাদর্শিক পাওয়ার। পাওয়ার উপরে নিচেও কিছু না।

আমার সাহিত্যের বোঝার বিষয় এইটা না যে, পাওয়ার কীভাবে কাজ করে? আমার মূল চিন্তাটা যে, পাওয়ার থাকে বা পাওয়ার আছে, এইটা সভ্যতাকে আগায়া নিচ্ছে। আমার চিন্তাটা অনেকটা এইরকম।

চেষ্টা করলাম একটু বোঝানোর। তার ফলে সাথে সাথে আমার সাহিত্য আসলে যেকোনও রাষ্ট্র যেভাবে তার পাওয়ারকে দেখায়, তার ক্রিটিক হয়ে দাঁড়ায়। সো আমার সাহিত্য কোনোদিনও, আমার কাভারে যখন এরকম লেখা লাগাই—সিস্টেম কেন চালায়, কারা চালায়, অতএব আমার কোনো লেখালেখি কখনোই কোনো শাসকশ্রেণীর পারপাজ সার্ভ করবে না।

কোনও লেখকের লেখা যদি শাসকশ্রেণীর পারপাজকে সামান্যতম ভাবেও সার্ভ করে, আমার ডাউট আছে ওই লেখকের কমিটমেন্ট লেভেলটা নিয়ে, এবং ওই লেখকের লেখার টিকে থাকা নিয়ে। ওই লেখকের লেখা, লেখা হওয়া নিয়ে। স্বার্থ ভিত্তিক দলিল ওগুলা, সাহিত্য নয়। যেমন শেখ হাসিনার রুই মাছ চাষে ভূমিকা, এই তো? এই ধরনের জিনিস তো আমাদের পক্ষে সম্ভব না, অসম্ভব।

আমার সাহিত্যের বোঝার বিষয় এইটা না যে, পাওয়ার কীভাবে কাজ করে? আমার মূল চিন্তাটা যে, পাওয়ার থাকে বা পাওয়ার আছে, এইটা সভ্যতাকে আগায়া নিচ্ছে।

রাইসু: তো আপনি যদি এখন মানে আগস্ট আবছায়ার কথা ভাবেন, এটা তো প্রথম উপন্যাস ছিল আপনার তাই তো? এইটার ব্যাপারে আপনার কী ধরনের মানে সাহিত্যিক সমালোচনা আছে কিনা কোনো রকম?

মাসরুর: আগস্ট আবছায়া নিয়ে একটা সেলফ ক্ল্যারিফিকেশন অর্থাৎ নিজেকে নিজের বোঝা, আগস্ট আবছায়া আসলে একটা ভাল কাজ, অনুবাদটা একদম রেডি। সামনেই বের হচ্ছে, আমাকে জ্ঞানী গুণীরা মানা করলেন, এই পাঁচই আগস্টের পরে। আসলে এই আগস্ট মাসেই বের হওয়ার কথা ছিল ইংরেজি ভার্সনটা। মানা করলেন যে এক্ষণি বের কোরো না, বাট এখন সামনে বেরোচ্ছে।

রাইসু: এমনিতে কি দেশ থেকে বের হচ্ছে? মানে কোথা থেকে বের হচ্ছে?

মাসরুর: আগস্ট আবছায়া ইনিশিয়ালি বের হচ্ছে আপনার পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া থেকে। আগস্ট আবছায়ার জন্য অন্য এজেন্টও আছে। আগস্ট আবছায়া আপনার ইন্টারন্যাশনালিও আটলান্টিকের এপার ওপার থেকে দু’পার থেকে বেরোবে। বাট প্রথমটা বেরোচ্ছে, বের হওয়ার শর্তের সাথে দ্বিতীয় ওই দুইটা বের হওয়াটা যুক্ত।

সো এটা এই মুহূর্তে স্টলড, এটা এই মুহূর্তে বন্ধ। তো আমার যেটা আছে যে, আগস্ট আবছায়া দিয়ে আমার নিজের পরিস্থিতি এবং নিজের সিচুয়েশন বোঝা, একটা সিচুয়েশন, আরেকটা সারকামস্ট্যান্সেস, দুইটা আলাদা জিনিস তো। এই সেলফ ক্লারিফিকেশনের জায়গাটা সাহিত্যিকের খুব দরকার৷ সেলফ ক্রিটিসিজম না।

তো আমি সামনে কী লিখতে চাই, আগস্ট আবছায়া দিয়ে তার একটা বুনিয়াদ আমার জন্য ভালই তৈরি হয়েছে। যে, কীভাবে কাহিনি আগানো যায়। মাল্টিপল পারস্পেকটিভের জিনিস আসলে একই গল্পে আসতে পারে। এবং গল্পের কাঠামো, গল্পের কোনো রৈখিকভাবে আগানো—এই পুরো জিনিসটাই আল্টিমেটলি আমরা টেক্সট বুকে যেগুলি পড়ি, সেগুলি বিষয় না, বিষয়টা গল্প বলতে পারার সক্ষমতা। বিষয়টা গদ্যের সৌন্দর্য, বিষয়টা আপনার অনেক কিছুর ঐক্য। বিষয়টা টোটাল কোহারেনসের বিষয়। আগস্ট আবছায়া আমার কাছে মনে হয়, প্রাঞ্জলতার একদম ক্লাসিক্যাল বিচারে কোহেসিভ না, কোহারেন্ট না। বিকজ এর অনেকগুলা বিষয় আছে। নেপালের ভূমিকম্প, সিআইএর ষড়যন্ত্র, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, বসুন্ধরায় একটা বিশাল একটা কিছু এইখানে, একটা আজব এক মহিষের সিম্বল দিয়ে বড় একটা ঘটনা।

আগস্ট আবছায়া তো অনেকগুলো আবছায়া এবং পৃথিবী কারা চালাচ্ছে, তাদেরকে নিয়ে কিছু কথা। এক ইন্ডিয়ার গরিব ড্রাইভারের সঙ্গে নায়কের গিল্ট নিয়ে কথা। গিল্ট এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে নায়কের গিল্টের একটা ডিরেক্ট যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। বাকিগুলা তো এতখানি লিঙ্কড না, আমার এটা মনে হল বাংলা সাহিত্যে এ রকম ধরেন লিঙ্ক বিহীন… লিঙ্ক নাই আবার আছে এই ধরনের লেখালেখিরও…।

রাইসু: আবছায়া শব্দটা কি লিঙ্ক না থাকা বা এই যে কোনো কিছু যে স্পষ্ট না বা নির্দিষ্ট না বা একেবারে সরাসরি না ওই জিনিসগুলি কি “আবছায়া” শব্দ দিয়ে আপনি আনতেছেন?

মাসরুর: আগস্ট আবছায়া—আমার নিজের ভিতরেই তো একটা আবছায়া। ইটস এ শ্যাডো, একটা আবছায়া পরিস্থিতি, এটা ফ্যান্টম টাইপের একটা কিছু।

রাইসু: মানে, যা আছে তা নাই?

মাসরুর: যা আছে তা নাই, ছায়া এক জিনিস আর আবছায়া কিন্তু আরেক জিনিস।

রাইসু: এই উপন্যাসে মহিষ তো একটা বড় ক্যারেক্টার মূল ক্যারেক্টার বলা যেতে পারে এবং প্রচ্ছদের মধ্যেও ওইটা আছে। তো এই মহিষটা নিয়ে আপনি কি কখনও বলছেন কোথাও যে কেন মহিষ আসছিল এই উপন্যাসে?

মাসরুর: আমার মনে হয় না যে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, একটা তো সিম্বল থাকে। এখানে মহিষ বীভৎসতা, মহিষ সভ্যতার একটা নিষ্ঠুর ছুটে চলার প্রতীক। তার মুখের চারপাশে জিঙ্ক অক্সাইড ফেনা। মহিষের বর্ণনাগুলো তো প্রচণ্ড কাব্যিক এখানে।

রাইসু: নৃশংসতার সঙ্গে।

মাসরুর: নৃশংস মহিষ এশিয়ান ওয়াটার বাফেলো। ওকে যদি একবার ক্ষ্যাপাও তো পৃথিবীতে কেউ ওকে থামাতে পারবে না ।

রাইসু: না আমি যেটা বলতে চাইলাম যে ধরেন বাঘ, বাঘ অনেক শব্দ করে, গর্জন করে এবং আক্রমণ করে। ফলে ওই ভয়টা মানুষ পায় হচ্ছে রিফ্লেক্স থেকেই সে ভয়টা পায়। কিন্তু মহিষের তো মুভমেন্টের মধ্যে ভয়টা তৈরি হয়, অর্থাৎ সে ওই গর্জনটা কিন্তু করে না মহিষ—ঠাণ্ডা ব্যাপার একটা।

মাসরুর: ওইটাই আবছায়া। ধরেন বাঘ যদি আনতাম বা অন্যরকম কোনো প্রাণী যদি আসতো সিম্বল হিসেবে, আসতেই পারতো কারণ এ দেশ তো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের দেশ, এ দেশে তো কী পরিমাণ ভয়ঙ্কর হিংস্র প্রাণী ছিল, এখন বিলুপ্ত। তার প্রত্যেকটাই জানি। কারণ ‘মেইন কুন’ নামে একটি উপন্যাস নিয়ে কাজ করছি। বাট মহিষের ভিতরে যে ঠাণ্ডা স্থির বিউটি এবং তার রামদার মতো যে শিং—এই রামদার মতোন শিং যা আবার দেখতে চাঁদের মতন এবং যার মুখে ফেনাগুলো সাদা জিঙ্ক অক্সাইড টাইপের।

তো মহিষ ওভার অল তো এই কথাগুলোর মধ্যে বোঝা যাচ্ছে যে মহিষ কীসের আর্কিটাইপ হিসাবে এই উপন্যাসে এসছে। বাট যে কথা ধরেন কখনও বলি নাই, মাঝে মধ্যে ভাবি ধরেন এই মহিষ একটা লেভিয়াথান, যেটা টমাস হব্‌সের তিমি। আমি শিওর আমি জানি না কতটুকু জানেন যে তার মতন বড় প্রভাবশালী দার্শনিক তো কম, তার বইয়ের এই তিমি আসলে তো সভরেইন (sovereign)।

সার্বভৌম বিষয়গুলো যে রাষ্ট্রের, সমাজেও যা সার্বভৌম বিষয়, যাকে যাকে সার্বভৌম ভাবি সেটা লেভিয়াথান—সেটা তিমি। ভয়ঙ্কর ব্লিক অন্ধকার একটা পিকচার হিসাবে আসছে। বাট তিমি কিন্তু এত ভয়ঙ্কর না দেখতে, এত না।

কিন্তু হব্‌স পুরো জিনিসটাকেই বলে দিল যে মানুষ জন্মই নিচ্ছে পরস্পর যুদ্ধ করতে। তারপরেই তারা সমাধানে আসল যে যেহেতু আমি আর তুমি যুদ্ধই করব তাহলে দুজনের নিরাপত্তাও দরকার। তাহলে একটা রাষ্ট্র দরকার, যে আমাদেরকে নিরাপত্তা দিবে। ওই রাষ্ট্রকে হবস অন্য কিছু যেমন গোলাপ ফুলও বলতে পারত। কিন্তু লেভিয়াথান বলল। মহিষ আসলে সভরেইন পাওয়ার অফ এ সিস্টেম, সভরেইন পাওয়ার অফ এ স্টেট, এ রকম রামদার মতো বাঁকানো মহিষ দেখতে শান্তশিষ্ট…।

রাইসু: মোটিফ হিসাবে আসবে?

মাসরুর: মোটিভ, ওইটাই চিন্তা ছিল যে ভায়োলেন্সটা মহিষে চিত্রিত। এই লেভিয়াথান অফ হবস আমার এশিয়ান ওয়াটার বাফেলো অফ মাই আগস্ট আবছায়া।

রাইসু: এই ধরনের মোটিফ কি আপনার অন্য কোনো উপন্যাসে আছে?

“আমার তো সাক্ষাৎকারের বইটা ইকতিজা আহসানের নেওয়া। আমার চেয়ে বয়সে কম।”

মাসরুর: এই ধরনের বলতে?

রাইসু: যেটা কিনা মূল ভাবকে একটা গানের মত করে আগায় নেয়।

মাসরুর: আমার অন্য উপন্যাসে তো ধরেন ‘আলথুসার’-এ তো তিমি আছে। যেটা আপনার নিজের, আমার নিজেরও মনে হয় সেরা গদ্য, ওই দুইটা তিনটা পাতা। আলথুসার-এ একটা টেবিলের মধ্যে ভয়ঙ্কর তিমি পড়ে থাকে। কারণ আলথুসার পরিবেশবাদের উপরে একটা ক্রিটিক। পরিবেশবাদ নিয়ে একটা আলোচনা, একটা উন্মোচন।

তাই তো একটা তিমিকে, পৃথিবীর শেষ গ্রে হোয়েল সে, তাকে টেবিলে ফেলা হল এবং উপন্যাসের নাম রাখা হল আলথুসার। যে আলথুসার নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক প্রবক্তা। আইডিওলজিকাল নিপীড়ন এবং ইনস্টিটিউশনাল নিপীড়ন, এই দুইটাই তো ইম্পরট্যান্ট কথা।

আলথুসারই তো বললেন যে স্কুল নিপীড়নের একটা হাতিয়ার, পরিবার নিপীড়নের হাতিয়ার, মসজিদ, মন্দির, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের হাতিয়ার। তিমি তো নিপীড়িত হয়ে ওই টেবিলে পড়ল। আলথুসার উপন্যাসে ওই তিমি পরে ওটাকে মোটিভ হিসেবে সামনে টানিনি, কারণ আলথুসার ইজ আগস্ট আবছায়ার চেয়ে বিস্তৃত।

“আল্থুসারকে মনে হয় খুবই, ইউ নো, ডিসসিমিলার আইটেমগুলোকে এক টেবিলে নিয়ে আসা। আলথুসার আমার মনে হয় এই সব জায়গা থেকে আমার সেরা লেখা।”

এই অর্থে যে ওই উপন্যাস লুই আলথুসার এবং কমিউনিজম এর মৃত্যু এবং রাষ্ট্রের যে আপনার টোটালিটারিয়ান বিষয়টা সেটার—একটু সরল সোজা চোখে উন্মোচন। এই রাষ্ট্রগুলোকে এখন আবার নতুন ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশ নিয়ে এখন প্রচুর বলা শুরু হয়ে গেছে।

তো আল্টিমেটলি গিয়ে পরিবেশ নিয়ে যে এতদিক থেকে এত চিৎকার শুরু হচ্ছে, সেখানে আবার কিন্তু আপনি সিস্টেমের মডিফিকেশন নিয়েই বলছেন। সিস্টেম তো বহমান। এই পরিবেশ নিয়ে তো আপনি আঠারোশো সালে এভাবে বলেননি। সো দিস ইজ এ নিউ এলিমেন্ট। আগে আপনি ধর্ম নিয়ে বলতেন।

রাইসু: আপনার লেখালেখির মধ্যে কবিতা এবং উপন্যাস দুই জায়গাতেই ক্ষমতা একটা বড় ব্যাপার এবং এই ক্ষমতা আনতে গিয়ে ক্রুয়েলটি দেখান। মানে ক্রুয়েলটি কি আপনাকে ক্ষমতাকে বুঝতে সাহায্য করে কিনা? আপনার তৈরি করা ক্রুয়েলটি।

মাসরুর: এইখানে আপনি সুন্দর একটা প্রশ্ন করেছেন। আলথুসার এর কিন্তু আমার সেকেন্ড পার্টটা বলা হয়নি। আলথুসারের মাত্রা বা ডাইমেনশন বেশি বিকজ একইসাথে জীবনানন্দ দাশ নিয়ে এটা একটা এলিজি অর্থাৎ তার ধানসিড়ি নদীটা এখন নাই।

আলথুসার-এ মায়া বেশি। একটা নৃশংস পৃথিবী, যেখানে নিপীড়নমূলক রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস এবং আইডিওলজিকাল স্টেট এপারেটাস রাষ্ট্রকে আরও বিস্তৃত করছে। এবং মানুষ আরও সঙ্কুচিত জায়গায় চলে যাচ্ছে। ছেলে মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে, যেটা ঢাকার চারপাশের এনজিও রিপোর্ট থেকে আলথুসারে নেওয়া। এরই মধ্যে পরিবেশ নিয়ে মানুষ চিৎকার করছে। আমার বটগাছ, আমার থানকুনি পাতা, আমার পাখির উড়াল—এরকম একটা জায়গায় জীবনানন্দ দাশও ন্যাচারালি চলে আসছে।

আল্থুসারকে মনে হয় খুবই, ইউ নো, ডিসসিমিলার আইটেমগুলোকে এক টেবিলে নিয়ে আসা। আলথুসার আমার মনে হয় এই সব জায়গা থেকে আমার সেরা লেখা। আমি জানি না আপনার প্রশ্ন এটা ছিল কিনা। এখানে কোনও আলাদা ভাবে মোটিফ আল্টিমেটলি আর তৈরি হয়নি। ধানসিড়ি নদী এখানে মেইন মোটিফ, উপন্যাসে।

(চলবে)

ইউটিউব ভিডিও

লিংক
উইকিপিডিয়ারকমারিপ্রথমা